জার্মান সাংবাদিক ও লেখক পিটার শ্যুট। জন্ম ১৯৩৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। বেশ কয়েকটি বইয়ের রচয়িতা ও সাবেক কমিউনিস্ট রাজনৈতিক হিসেবে তার বেশ পরিচিতি রয়েছে। লেটস গো ইস্ট, ব্ল্যাক পয়েম্স ও জার্নি টু সাইবেরিয়া ইত্যাদি তার আলোচিত বই। সামাজিক কার্যক্রমে তিনি বেশ কর্মোচ্ছ্বল ও সক্রীয়।
সংবাদমাধ্যমকে পিটার জানিয়েছেন, মুসলমান হওয়ার জন্য তাকে কেউ কখনো চাপ দেয়নি। বরং শৈশব থেকেই তিনি ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত ছিলেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও নিজের সদিচ্ছায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণের সংক্ষিপ্ত গল্প বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
সত্যের সন্ধানে বহুদূর: জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় আমি ব্যয় করেছি, সত্য ধর্মের সন্ধানে। আমার জন্ম লুথেরান পরিবারে। বয়স যখন উনিশ, তখন আমি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেছিলাম। কারণ আমি আমার লুথেরানীয় পরিবারের সংকীর্ণতা থেকে দূরে সরে যেতে চাচ্ছিলাম। তখন আমার অনেক বেশি আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন অনুভব হচ্ছিল।
এটাই ছিল আমার জীবনে সত্যের পথে যাত্রার মাধ্যম। কারণ আসলেই এটি আমার জীবনের ফারাক-ফাটল আমাকে বুঝিয়ে দেয়। এর ত্রিশ বছর পরে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলাম। তবে ইসলাম গ্রহণ আমার জীবনে কোনো ফাটল-বিচ্ছেদ তৈরি করেনি। বরং এটি ছিল আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও উপলব্ধি অর্জনের জন্য আমার অনুসন্ধান-প্রচেষ্টার চূড়ান্ত ফলাফল।
ইসলামী প্রার্থনার নিয়ম-নীতি পর্যবেক্ষণ: সত্যি বলতে কি, আমি খুব ছোট থেকেই ইসলামের প্রতি মুগ্ধ ছিলাম। আমি যুদ্ধোত্তর জার্মানির একটি ছোট্ট গ্রামে বড় হয়েছি। আমরা জার্মানির যে অংশে বাস করতাম, সেটি ব্রিটিশদের দখলকৃত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত থেকে আগত সৈনিকরা মুসলমান ছিলেন। তারা এখানকার বাচ্চাদের প্রতি খুব সদয় ও দয়ার্দ্র ছিলেন। তারা আমাদের খেজুর ও ডুমুর ফল ইত্যাদি খেতে দিতেন।
শৈশবে তখন আমরা তাদের ইবাদত-প্রার্থনা পালন দেখতাম। তাদের প্রার্থনা পর্যবেক্ষণে আমি খুব আগ্রহী ছিলাম। ইসলামী রীতিতে নামাজ-প্রার্থনার শৈশব-শিশিরের এই স্মৃতি আমার সঙ্গে এখনো বয়ে বেড়ায়।
মক্কা নগরী ও হজযাত্রার প্রতি আমার আগ্রহ: আমাদের গ্রামের কাছেই একটি প্রাচীন গির্জা ছিল। তাতে আমি খ্যাতিমান জার্মানদের দেখেছিলাম, যারা ইসলামের প্রতি আগ্রহী ছিল। চার্চের যাজক আমাকে সেই বিখ্যাত জার্মানদের সম্পর্কে বলেছিলেন, যারা ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ কার্স্টেন নিবুহরের কথা বলা যায়, বিখ্যাত জার্মান কবি গ্যোথে তাকে প্রথম জার্মান হাজি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (কবি গ্যোথের ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহ সুবিদিত।)
এই গল্পগুলো আমার হৃদয়-উদ্যান উত্তেজনা ও কৌতূহলে পূর্ণ করে দেয়। আমি ‘মক্কা’ নামক বিশেষ জায়গাটি সম্পর্কে ও লোকেরা কেন সেখানে পৌঁছানোর জন্য দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করে তা সম্পর্কে আমি বেশ অবাক ও অনিসন্ধিৎসু ছিলাম।
মুক্তির ধর্মতত্ত্ব আবিষ্কার: বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় আমি ইসলামের সংস্পর্শে এসেছি। এসময় আমি প্রাচ্যের শিল্প-সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেছি। ছাত্রাবাসে ইরান, মিশর ও নাইজেরিয়ার মুসলিম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমি একই ঘরে থাকতাম। ধর্ম-বিশ্বাস ও তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা অনেক রাত কাটিয়েছি। ক্যাম্পাসে আন্তঃ-ধর্মীয় সংলাপ ফোরামের আয়োজনও করেছি।
সেই সময়ে আমি ইসলামকে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মুক্তির ধর্মতত্ত্ব হিসেবে দেখতে পেয়েছি। আমি তখন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলাম এবং ছাত্র-বিদ্রোহে অংশও নিয়েছিলাম।
আমার মসজিদটি যেখানে: শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালে আমি ইসলাম গ্রহণ করি। হামবুর্গের আলস্টারের নিকটে ইসলামিক কেন্দ্রটি আমার মসজিদে পরিণত হয় তখন। এটি তখন এবং এখনও একটি আধুনিক মসজিদ হিসেবে পরিচিত। এটি কেবল ইবাদত-উপাসনার স্থান নয়; বরং বিভিন্ন বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ ও কার্যক্রমেরও স্থান।
আন্ত-ধর্মীয় সংলাপ ও আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ নিয়মিত ঘটনালির অন্যতম। বিশ্বের আলোচিত ও নন্দিত বক্তারা ইসলাম সম্পর্কে কথা বলতে এই কেন্দ্রে আসতেন। ঠিক তেমন এখানে একজন আসেন, যার নাম মেহেদী রাজভি। তিনি আমার এমন শিক্ষক ছিলেন যে, আমাকে ইসলামের প্রতি পরিচালিত করেছিলেন।
ধর্ম রূপান্তর ও সত্যিকার মুসলিম হতে: শেষ সিদ্ধান্ত নিতে আমার জীবনের অর্ধেক সময় কেটে গেছে। এখন আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। এটি পুরোপুরি একটি নতুন পথে যাত্রা আমার।
আপনি একবার কালেমা শাহাদাত পাঠ করলে এবং ইসলাম গ্রহণের অর্থ বলতে পারলে, আপনি মুসলমান হয়ে যাবেন। তবে আপনার সারাটা মন-মস্তিষ্ক ও প্রাণ দিয়ে সত্যিকারের মুসলমান হতে চাইলে প্রতীকী-বিশ্বাসের উচ্চারণের চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন।
একজন সত্যিকারের মুসলিম হওয়ার জন্য দীর্ঘকালীন অনুশীলন ও শিক্ষা-প্রক্রিয়া প্রয়োজন। প্রতিটি দিন আপনাকে নতুন করে শুরু করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়। ১৯৬৭ সালে আমার শিক্ষক আমাদের ইসলামিক কেন্দ্রে ধারাবাহিকভাবে কোরআনের ব্যাখ্যা পড়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরিরাও এখনো পুরো কোরআন শেষ করতে পারেনি। কোরআন বোঝার জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন।
আমি মুসলিম হিসেবে জন্মগ্রহণ করিনি। আর আমাকে কেউ মুসলমান হওয়ার জন্য চাপও দেয়নি। রাতেও (অগোচরে) আমি ইসলামে দীক্ষিত হইনি। বরং সত্য খুঁজে পাওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অংশ ছিল এটি। যদি আল্লাহ চান, আমি জীবনের প্রতিটি দিন কাটিয়ে সত্যের আরও নিকট থেকে নিকটতর হতে থাকবো ইনশাআল্লাহ।
ডিসকভারিং ইসলাম থেকে অনুবাদ করেছেন: মুফতি মুহাম্মাদ মিনহাজ উদ্দিন