Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

india-bangladesh-flagবাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন এমন এক সময়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের উপর তাঁর আস্থা প্রকাশ করেছেন, যখন আসামের নাগরিক পঞ্জিতে যাদের তাদের অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি ধামকি দিচ্ছে ভারত। এতে বিএনপিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা অবাক হয়েছেন। অনেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই ভারতপ্রীতির প্রতিবাদও করেছেন।

ভারত যে কখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে অন্তর থেকে সমর্থন করে না, তার ভূরি ভূরি নজির আছে। আসলে ভারতে এমন কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যা ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষকে অবিভক্ত রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীনতা সমর্থন করতো না। এমন কি যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে পৌনে দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, সে কংগ্রেসও ছিল অখÐ ভারত হিসাবে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সমর্থক।

chardike-ad

আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে যারা সম্মক অবহিত, তারা সাক্ষ্য দেবেন, সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে দু’টি রাজিৈনতক দল স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল। এর একটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, আরেকটি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। প্রথমটি অখÐ ভারতের সমর্থক ছিল। দ্বিতীয়টি ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাসমূহ নিয়ে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি ছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস শুধু অখÐ ভারতেরই সমর্থক ছিল না, কংগ্রেস দাবি করতো যে তারা ভারতের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই স্থানীয় প্রতিনিধি। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগ দাবি করতো ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের মুসলিম জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে মুসলিম লীগ।

এই ইস্যুতে ১৯৪৬ সালে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে মুসলিম লীগের দাবির বাস্তবতা প্রমাণিত হয়। ফলে ভারতের কংগ্রেস-সহ সকল রাজনৈতিক দলই মুসলিম লীগের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে এ ব্যাপারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু-অধ্যুষিত অঞ্চলের রাজনৈতিক দলের নেতারা যে একমত ছিলেন না, তার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যদিয়ে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীন ভারত গোড়া থেকেই একটি অবিচ্ছিন্ন জনপদে অবস্থিত হলেও ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাসমূহ নিয়ে গঠিত হয় যে রাষ্ট্র তার নাম ছিল পাকিস্তান, তা ছিল উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের দুই প্রান্তের বিভিন্ন জনপদে অবস্থিত। ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে জন্মলগ্ন থেকেই কিছু বিশেষ সমস্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়।

পাকিস্তান নামের তদানীন্তন এই রাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ নামে চারটি প্রদেশ এবং কাশ্মীর নামের একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশীয় রাজ্য থাকলেও পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পূর্ববঙ্গ নামে একটি মাত্র প্রদেশ ছিল। অথচ পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের পশ্চিম অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার চাইতেও অধিক। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার সবাই ছিলেন বাংলা ভাষাভাষী। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে পাঞ্জাবি, সিন্ধী, পশতু প্রভৃতি ভাষা প্রচলিত ছিল, যদিও তাদের শিক্ষিত সমাজ উর্দু ভাষা মোটামুটি বুঝতেন। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়।

তাছাড়া পাকিস্তানের রাজধানী এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী তথা সমগ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ববঙ্গের জনগণের মধ্যে একটি বঞ্চনা বোধ কাজ করতে থাকে। এর ফলে পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্ত¡শাসনসহ বিভিন্ন আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের মধ্যে স্বাধিকারের চেতনা জন্ম দেয়। পূর্ববঙ্গের জনগণের এই স্বাধিকার চেতনাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবাঙ্গালী সেনা সদস্যরা পশুবলে ধ্বংসের চেষ্টা করলে পূর্ববঙ্গের জনগণ তার বিরুদ্ধে মরণ পণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মাত্র নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে সক্ষম হয়।

উনিশ শ’ একাত্তরের সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ ভারত সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তবে তাদের এ সহায়তার লক্ষ্য যে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ গড়ে তোলা ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তীকালে। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দেয়ার নামে যেসব ভারতীয় সেনা বাংলাদেশে পাঠায় ভারত, তা মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও বাংলাদেশে থেকে যায়। এমনকি তারা কবে তাদের স্বদেশ ভারতে ফিরে যাবে সে সম্পর্কেও কিছু না জানানোতে বাংলাদেশের জনগণের মনে নানা আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।

এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের জনগণের নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে যারাই তাঁর বাসায় গেছে তাদেরকে যথা শীঘ্র সম্ভব ভারতে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেও তিনি নিজে তাঁর বাসভবনে থেকে যান এবং শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন। ফলে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পাকিস্তানে কারাবন্দি থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি প্রথম লন্ডন যান, সেখানে গিয়ে তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থানের কথা জানতে পারেন। এটা জানার পর পরই তিনি এ বিষয়ে তার ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেলেন।

তিনি (শেখ মুজিব) লন্ডন থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে নয়া দিল্লিতে স্বল্প বিরতির সুযোগে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, আপনার বাহিনী কখন বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিশ্বব্যাপী যে জনপ্রিয়তা তাতে অন্য কোন জবাব দেয়াই ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য অপসারণ সহজ হয়ে ওঠে।

দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে ভারতে যে দলটি রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত রয়েছে, সেটি ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নয়। বর্তমানে ভারতের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে রয়েছেন এমন এক কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতা, যিনি অতীতে তাঁর জন্মভূমি গুজরাটে মুসলিম-বিরোধী গণহত্যা চালিয়ে ‘গুজরাটের কসাই’ নামে কুখ্যাত হন। তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত থাকার ফলে ভারতের একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য কাশ্মীরের জনগণকে ভারতীয় সেনা-সদস্যদের চরম নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে। কাশ্মীরের মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন, গ্রেপ্তার, ধর্ষণ- কোন জুলুম-অত্যাচারই বাদ রাখছে না তারা।

শুধু কাশ্মীরেই নয়। আসামেও যারা যুগের পর যুগ ধরে বাস করে আসছে তাদেরকেও নাগরিক পঞ্জি থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে তাদের রাষ্ট্রবিহীন মানুষে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে। শুধু কাশ্মীরে বা আসামেই নয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও যেসব মুসলিম অধিবাসী যুগ যুগ ধরে যে রাজ্যে বাস করে আসছে, তাদেরকে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে ভারতের কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপির পশ্চিমবঙ্গীয় নেতারা।

এসবের মূলে রয়েছে ভারতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপি, যাদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর একাধিক স্থানে ভারতের মুসলমানদের উপর ঘটে বর্বর নির্যাতনের ঘটনা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যে নেতাকর্মীরা প্রচারণা চালানোর সময় সব ধরনের শিষ্টতা ও লজ্জার মাথা খেয়ে বলতেন, ভারতের মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বিজেপি নেতাকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে হবে। যে দলের নেতাকর্মীরা এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেন, সে দল ক্ষমতায় গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের শাসনব্যবস্থা যে চরম বর্বর হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?

গত সোমবার ঢাকার প্রাচীনতম দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘দুই প্যাকেট খাবার দিয়ে অবৈধদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’ উপশিরোনাম ছিল: ‘পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতার হুমকি’। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে যারা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন, মুসলিম হবার অপরাধে তাদেরকেও অবৈধ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর লক্ষ্যে এ হুমকি। এরপরও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যদি বলেন, ভারতের উপর বিশ্বাস রাখছি, তাহলে মন্ত্রীর এই ভারত-প্রীতির উৎস কোথায়, তা জানার অধিকার আছে বাংলাদেশের জনগণের। মোটকথা ভারতের কোনো কোনো নেতা যেমন অতীতেও এককালের পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশ্বাসী ছিল না, এখনও নেই। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সাহায্য দান করে, তা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে দেখার লক্ষ্যে নয়। পাকিস্তান নামের বৃহত্তর রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে তার দুই অংশকে দুর্বল করে দেয়ার লক্ষ্যে।

লেখক- মোহাম্মদ আবদুল গফুর, দৈনিক ইনকিলাব