দীর্ঘ অপেক্ষার পরও আলোর মুখ দেখেনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্ধ শ্রমবাজার। দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্রমবাজার রেমিটেন্স প্রেরণের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও গত সাত বছরেরও বেশী সময় ধরে দেশটিতে বাংলাদেশের ভিসা বন্ধ। নানা সময় নানা গুঞ্জন শোনা গেলেও কার্যত কোনো ফলাফল আসেনি ভিসা জটিলতার।
নতুন শ্রমিক ভিসা বন্ধ ও অভ্যন্তরীণ মালিক পরিবর্তনের সুযোগ বঞ্চিত অসহায় অসংখ্য প্রবাসী গত সাত বছরে দেশে ফিরেছেন ক্রমাগত হারে। কমেছে আমিরাতে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা। যেখানে ভিসা বন্ধের আগে ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গড়ে দুই লাখ করে শ্রমিক কর্মের সন্ধানে সেখানে যেতেন।
২০১২ সালের আগস্ট মাসে হঠাৎ করে দেশটি বাংলাদেশি শ্রমবাজার সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশিদের অভ্যন্তরীণ মালিক পরিবর্তনের সুযোগও। গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার, আমিরাতের কমিউনিটি এবং সাধারণ প্রবাসীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভিসা চালুর জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কূটনৈতিক পদ্ধতিতে। আমিরাত সরকারের কাছে অনেক বার ভিসা চালুর জন্য বলা হয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে- এমনটাই বিভিন্ন মাধ্যমে জানানো হয়েছে।
শ্রম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভিসা চালুর জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে একাধিকার বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। আমিরাতের সাথে আলোচনার কথা উল্লেখ করে দেশের একাধিক মন্ত্রী ফেসবুকে পর্যন্ত পোস্ট করেছেন। শুধু তাই নয় একজন মন্ত্রী ফেসবুকের মাধ্যমে জানিয়েছেন আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত ভিসা চালু হয়নি। আমিরাতের প্রবাসী কমিউনিটি থেকে নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ভিসা চালুসহ আমিরাত সরকারের কাছে বাংলাদেশকে পজেটিভ দেশ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য। সেই অনুযায়ী ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে দুবাই সোশ্যাল ক্লাবের নেতৃত্বে প্যারেডে অংশ নেয় শতাধিক প্রবাসী।
২০১৬ সালে আমিরাতের ৪৫তম জাতীয় দিবসে ৪৫ পাউন্ডের কেক কেটে, আলোচনা অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবসের পিকনিকসহ জাতীয় দিবসে নানান আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে একাধিক সামাজিক সংগঠন।
এছাড়া সাধারণ প্রবাসীরা আগের চেয়ে অনেক সচেতন। আমিরাতে বাংলাদেশী প্রবাসীদের অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে কমেছে। আমিরাত প্রবাসীরা এখন নিজেদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বুঝতে শিখেছে। আমিরাতের আইনকানুন ঠিক মতো মেনে চলছে। আমিরাতের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের ত্রুটি দেখাচ্ছে না। আমিরতের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দেশটির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের পরও অজানা কারণে প্রায় সাত বছরেরও বেশী সময় থেকে ভিসা বন্ধ রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো এর জন্য সে দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে দাবি করছে।
আর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র এবং জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্তরা মনে করছে, ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০-এর ভেন্যু হিসেবে দুবাইকে সমর্থন দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এই সমস্যার একটি বড় কারণ। ওয়ার্ল্ড এক্সপোর আয়োজক হিসেবে শুরুতে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছিল বাংলাদেশ। যদিও দ্বিতীয় দফায় ভোটাভুটির সময় বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দুবাইকে ভোট দেয়। এতে কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের ব্যাপক অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়টি সরকার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ দরকার ছিল, তাও যথাসময়ে নেওয়া হয়নি।
এর কারণ, গত জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে সংঘাতময় রাজনীতিই সরকারের সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ছিল। ফলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি ফের জোরদারের বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে উপেক্ষিত থেকেছে।
ঢাকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, জনশক্তির গুরুত্বপূর্ণ বাজার আমিরাতে সম্প্রতি নিরাপত্তাজনিত কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার নাগরিকদের অপরাধপ্রবণতা কমাতে সচেষ্ট রয়েছে। এ ব্যাপারে আবুধাবি কর্তৃপক্ষের আস্থা অর্জন করতে পারলে ভিসা উন্মুক্ত হওয়ার বিষয়টি সহজতর হবে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আমিরাতে বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে অপরাধমূলক তৎপরতার ওপরের সারিতেই রয়েছেন বাংলাদেশিরা। সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি নৃশংস খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিকেরা। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে পতিতালয় ব্যবসা চালানো, গৃহপরিচারিকাদের জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করা, মানব পাচার, চুরি-ডাকাতি, নিষিদ্ধ পণ্যের চোরাচালান, মারামারি ও জুয়াসহ নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে সে দেশে ফাঁসির অপেক্ষায় আছেন ১৯ জন বাংলাদেশি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন ১০৪ জন। আট শতাধিক বাংলাদেশি বিভিন্ন অপরাধে নানা মেয়াদে কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
এর মধ্যে কয়েক দফা শ্রমবাজার চালুর গুঞ্জন শোনা গেলেও কার্যত এখনো কোন ভালো খবর নেই। কিন্তু বাজার চালু হবে, হচ্ছে এমন আশায় নতুন নতুন বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন অনেক প্রবাসী ব্যবসায়ী। এখন গুটিয়ে ফেলছেন সেসব।
দুবাইয়ের কারামা এলাকায় প্রায় ১ যুগ আবাসন ব্যবসা করছেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে একটি রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন। বেশ খানিকটা এগিয়েছেও। কিন্তু এখন, পিছু হঁটতে চাচ্ছেন এই প্রবাসী ব্যবসায়ী।
কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, তার রেস্টুরেন্টে অন্তত ২০ জন কর্মী প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কর্মী আসা বন্ধ থাকায় এখন ভাবনায় আছেন তিনি। শ্রমবাজার চালুর খবরে ব্যবসা উদ্যোগ নিলেও, এখন থেমে যেতে হচ্ছে।
সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী আসলে, ভিসা দিয়ে তাদের কাছ থেকে অন্তত দুই লাখ করে টাকা নেয়া যায়। বেতন এক হাজার থেকে বারো’শ টাকা দিলেই চলবে। কিন্তু এই কর্মী পাকিস্তান বা ইন্ডিয়া থেকে নিতে গেলে সব খরচ দিয়ে কর্মী আনতে হবে এবং বেতনও বেশি চাচ্ছে। সব হিসাব করে এখন রেস্টুরেন্ট চালু করবেন কিনা ভাবছেন।
দুবাইয়ের শেখ জায়েদ সড়কের প্রবাসী ব্যবসায়ী সবুজ। এক দশকের মতো আছেন প্রবাসে। কয়েকটি দোকান আছে তার। নতুন করে একটি আধুনিক সেলুন চালু করতে যাচ্ছেন তিনি। দুজন ম্যানেজারসহ কর্মী প্রয়োজন ছয় থেকে সাত জন। কিন্তু বাংলাদেশী কর্মী আসার ব্যবস্থা না থাকায় ভাবনায় তিনিও।
সবুজ বলছিলেন, অন্যদেশের কর্মীদের ব্যবস্থাপনায় খরচ যেমনি বেশি, তেমনি আস্থার জায়গাটিও কম। বাংলাদেশি কর্মীদের যে আন্তরিকতা তা অন্য কোন দেশের কর্মীদের মধ্যে নেই বললেই চলে।
আল কারামা এলাকার আরেক প্রবাসী শাহাদত হোসেন। একটি দোকানের লাইসেন্স নিয়েছেন তিনি। ব্যবসা করার প্রস্তুতির আছে। কিন্তু কর্মী সংকটে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না তিনি।
আবুধাবির বেদা যাইদ এলার প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শুকুর মিয়া। কন্সট্রাকশন মেইনটেনেন্স ব্যবসা তার। ২৫ বছর আছেন দেশটিতে। আগে ৫টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখন আছে মাত্র দুটি। কর্মী সংকটে গুটিয়ে ফেলছেন ব্যবসা। এখন ভাবছেন, দেশেই চলে যাবেন।
শুকুর মিয়া প্রবাসী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেও সক্রিয়। বলছিলেন, “ভিসা চালু হবে, এতো আওয়াজ উঠলেও কোন কাজই হয়নি।” তার মতে কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই বাজারটি চালু হচ্ছে না। দ্রুত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কার্যকর ভূমিকা চান প্রবাসী ব্যবসায়ী শুকুর মিয়া। বাজার খোলা দেরি হলেও, অন্তত ভিসা পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আহবান জানান তিনি।
বেদা যাইদ এলাকার মরুভূমিতে কথা হচ্ছিল মোহাম্মদ গোলাপের সাথে। আট বছর আছেন তিনি এখানে। উটের খামার দেখভাল করেন। ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় বিপাকে এই রেমিটেন্স যোদ্ধা। সুযোগটি থাকলে, ভালো বেতনে অন্য কোম্পানীতে যেতে পারতেন তিনি।
সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসীরা বলছিলেন, ভারত, পাকিস্তানসহ প্রতিবেশি সকল দেশের ভিসা চালু আছে দেশটিতে। শুধু বাংলাদেশের জন্য বন্ধ। এতে করে দেশটিতে ইমেজ সংকটে তারা।
এদিকে দেশটিতে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক এক্সপো-২০২০। গুঞ্জন ছিল দুবাইয়ে আয়োজিত ওই আন্তর্জাতিক এক্সপো’র বিশাল কর্মযজ্ঞ ঘিরে হয়ত খুলে দেওয়া হতে পারে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার। সেই আশাও স্বপ্নের মতই রয়ে গেল। দুবাইয়ের জেবল আলীতে এক্সপো-২০২০ সাইটে দ্রুতগতিতে চলছে নির্মাণ কাজ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দালান, সড়ক, ব্রিজ, মেট্রোরেলের কাজ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই শেষের পথে। আন্তর্জাতিক এই মেলা বসবে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর, চলবে ১০ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত। ভোটাভুটিতে রাশিয়ার বিপরীতে জয় লাভ করা আয়োজক শহর দুবাইয়ে এক্সপো-২০২০ তে অংশগ্রহণ করবে বিশ্বের ১৯২টি দেশ। এতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দৈনিক ৬০টি লাইভ ইভেন্ট চলবে উল্লেখ্য করে গত ২৭ এপ্রিল টিকেট মূল্যও ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ঘোষিত টিকেটের মূল্য ধরা হয়েছে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্যে দৈনিক ৩৩ ডলার ও তিন দিনের প্যাকেজ ৭১ ডলার। তবে দেশটির ৬৫ বছর ও তার উর্ধ্ব বয়সের জৈষ্ঠ্য নাগরিক ও পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্যে বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ রেখেছে এক্সপো-২০২০ কর্তৃপক্ষ। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করলেও এই কর্মযজ্ঞ ঘিরে প্রত্যাশিত সেই লক্ষ্য অর্জন তথা ভিসা জটিলতা অবসান হয়নি।
দেশের লাখো পরিবার চলে এদেশের প্রবাসীদের উপার্জিত টাকায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটন্সের জন্য। সরকারের কাছে প্রয়োজন হলে কূটনৈতিক পদ্ধতি পরিবর্তন করে বা কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভিসা চালু বা ট্রান্সফার প্রক্রিয়ার সুযোগ আদায়ের দাবি জানান প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
সৌজন্যে- নয়া দিগন্ত