Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

yameenখুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইয়েমেন। মানুষের কাছে কাজ নেই, হাতে অর্থ নেই, মুখে খাবার নেই। ফলে বেশ কঠিন অবস্থায় পড়েছে দেশটি। এ পরিস্থিতিকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। চলমান যুদ্ধ পুরো দেশটিকে ঠেলে দিয়েছে দুর্ভিক্ষের দিকে। জাতিসঙ্ঘ বলছে, পুরোপুরিভাবে আক্রান্ত না হলেও দেশটিতে দুর্ভিক্ষ আসন্ন। চার বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের কারণে যেকোনো ধরনের সহায়তা, খাবার ও জ্বালানি ইয়েমেনে পাঠানোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আমদানি কমে গেছে এবং দেশটিতে দেখা দিয়েছে মারাত্মক পর্যায়ের মুদ্রাস্ফীতি। মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ ‘তীব্র মাত্রার খাদ্য অনিরাপত্তা’য় ভুগছে।

ইয়েমেনে জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়কারী লিসে গ্র্যান্ডে বলেছেন, ‘বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে প্রতিশ্রুত তহবিল পাওয়ার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কারণ, এ তহবিল না এলে অনেক মানুষকে আর বাঁচানো যাবে না।’ গ্র্যান্ডে জানান, তহবিল সঙ্কটের কারণে মে মাসে ভ্যাকসিন কর্মসূচির বেশির ভাগই বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে জাতিসঙ্ঘ। নতুন করে তহবিল পাওয়া না গেলে আগামী দুই মাসে ইয়েমেনে আরো ২২টি জীবন রক্ষাকারী কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাবে।

chardike-ad

ইয়েমেনের দুই কোটিরও বেশি মানুষের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২৬০ কোটি ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এ দুই দেশের প্রত্যেকে ‘ইয়েমেন মানবিক সহায়তাবিষয়ক পরিকল্পনা ২০১৯’ খাতে ৭৫ কোটি ডলার করে অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত এ তহবিলে সৌদি কর্তৃপক্ষ থেকে মাত্র ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৬ কোটি ডলার জমা হয়েছে।

মানবিক সহায়তা কর্মসূচি থমকে গেলে মানবিক বিপর্যয় অনিবার্য বলে সতর্ক করেছেন লিসে গ্র্যান্ডে। তিনি জানান, আসন্ন সপ্তাহগুলোতে প্রতিশ্রুত তহবিল যদি না পাওয়া যায়, তবে এক কোটি ২০ লাখ খাদ্য রেশনের পরিমাণ কমে যাবে এবং অন্তত ২৫ লাখ শিশু জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

২০১৫ সালে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদিকে উচ্ছেদ করে রাজধানী সানা দখলে নেয় ইরান সমর্থিত হাউছি বিদ্রোহীরা। সে সময় সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে পালিয়ে যান হাদি। ২০১৫ সালের মার্চে হাউছি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিত্রদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে সৌদি আরব। সৌদি জোটের অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত নারী-শিশুসহ ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ লোক।

ইয়েমেনে অভিযান চালানোর জন্য ১৭টি দেশকে নিয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করলেও এখন একটি বা দুটি দেশ এ জোটে কার্যকরভাবে অংশ নিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদিকে আবারো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার কথা বলে এসব অভিযান চালানো হলেও মূলত উভয় দেশই বিষয়টিকে নিজেদের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করে। অভিযান শুরুর প্রথম দিকে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পরস্পরের মিত্র হিসেবে থাকলেও বর্তমানে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ক্রমেই বাড়ছে। ইয়েমেনে উভয়েই স্বতন্ত্র যুদ্ধ-জোট গঠনে তৎপর। যদিও সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করতেই এ সামরিক জোটের অভিযান, কিন্তু কোনো কোনো সময় তারা সরকারি ও বিদ্রোহী বাহিনী উভয় পক্ষকেই সহায়তা দিচ্ছে।

আসলে ইয়েমেনকে ভেঙে দুটি দেশ করার পরিকল্পনা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা বর্তমান ইয়েমেনকে ভেঙে নব্বইয়ের দশকের আগের অবস্থায় অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনে বিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশ দুটির একটি অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ইয়েমেন থেকে তার বেশির ভাগ সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলে প্রেসিডেন্ট হাদির বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়।

এ অবস্থায় ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে ইয়েমেনের বিদ্রোহী জোটগুলো। তারা দেশেও যেমনি বিদেশী জোটের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিচ্ছে, তেমনি সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে অভিযানকারীদেরই পাল্টা ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। হাউছি বিদ্রোহীরা এখনো সানা এবং অন্যান্য অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে আছে এবং তারা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গত ১৭ আগস্ট সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় ‘শায়বাহ’ তেলক্ষেত্রে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ড্রোন হামলা চালায় তারা।

এরও আগে হাউছি বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা সৌদি আরবের শহর জাজান ও নাজরানের ১৫টি সামরিক ঘাঁটি নিজেদের কব্জায় নিয়েছে। বিদ্রোহীদের মুখপাত্র ইয়াহা সারি জানিয়েছেন, হাউছি বিদ্রোহীদের স্নাইপার ইউনিট গত জুলাইয়ে মোট ১৫৭৫টি সফল মিশন চালায়। তাদের পরিচালিত ওই মিশনে নিহতদের মধ্যে রয়েছে ১২ জন সৌদি সেনা এবং ২৬ জন সুদানি সেনা।

এ দিকে রাজনৈতিক উপায়ে ইয়েমেন সঙ্কট সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জন্য ইরানের রাজধানী তেহরানে বহুপক্ষীয় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ছিল ইউরোপীয় দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি প্রতিনিধিরা যেমন ছিল, তেমনি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদল, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া আরো কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অংশগ্রহণকারীরা যত দ্রুত সম্ভব ইয়েমেন যুদ্ধের অবসান এবং রাজনৈতিক উপায়ে এই সঙ্কট সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

ইয়েমেনের ব্যাপারে এখন দুটি বিষয় খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত, দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী চরম খাদ্যসঙ্কটে রয়েছে। এ অবস্থায় তাদের জন্য দ্রুত মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনা প্রক্রিয়া জোরদার করা। এর জন্য দরকার জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতায় বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা। বৈঠকে এ দুটি বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়।

কিন্তু আলোচনাতেই বিষয়গুলো সীমাবদ্ধ থাকবে, না আসলেই পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের ওপর। যদি তারা নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব পরিহার করে আসলেই ইয়েমেনকে পুনর্গঠন করতে চায় এবং অন্যদেরও সে সুযোগ দিতে চায়, তা হলেই শুধু ইয়েমেনের পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অন্যথায় দিন দিন পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে, আর দেশটি সত্যি সত্যিই দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে।