আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় এখনো এজাহারভুক্ত চার আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। এছাড়াও সিসিটিভি ফুটেজে বন্ড গ্রুপের সাথে যুক্ত ও এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা রয়েছে এমন কয়েকজনকে সনাক্ত করলেও তাদেরকে আইনের আওতায় আনেনি পুলিশ। বরং মামলার প্রধান সাক্ষী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে ঘিরেই পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। মিন্নিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কার্যসিদ্ধি মনোভাবের কারণে অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি অনেকটাই চাপা পড়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
গত ২৭ জুন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফের বরগুনা সদর থানায় দায়ের করা মামলায় ১২ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো বেশ কয়েকজনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারভুক্ত ৫নং আসামি মুছা বন্ড, ৭নং আসামি মুহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, ৮নং আসামি রায়হান ও ১০নং আসামি মোহাম্মদ রিফাত হাওলাদার এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এছাড়াও সিসিটিভি ফুটেজে সনাক্ত নাইম নামের একজন ও বন্ড গ্রুপের কয়েকজনকে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সনাক্ত করার পরও তাদেকরকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ওই মামলায় প্রধান সাক্ষী ছিলেন নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
১৬ জুলাই সকালে বাসা থেকে আসামি সনাক্তের জন্য ডেকে রাতে মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরেরদিন আদালতে হাজির করে রিমান্ড ও স্বীকারোক্তমূলক জবানবন্দি নেয় পুলিশ। মিন্নির জামিনের আবেদনের বিপরীতে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের জন্য মরিয়া ছিল পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা।
এ মামলার অন্যতম আসামি বন্দুকযদ্ধে নিহত নয়ন বন্ডের মা সাহিদা বেগমকে নয়নের মামা বাড়ি থেকে বরগুনার বাসায় নেওয়া হয়। নয়নের কক্ষে মিন্নির যাতায়াত সংক্রান্ত আলামত সংগ্রহ করা ও সেসব পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য ল্যাবে সরবরাহ করে পুলিশ। কুরবানি ঈদের আগেই এই মামলার চার্জশিট দেয়ার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন তদন্তকারী পুলিশের কর্মকর্তা। কিন্ত উচ্চাদালত মামলার ব্যাপারে ব্যাখা চাওয়ায় তড়িঘড়ি মনোভাব থেকে সরে সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে পুলিশ।
জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, উচ্চ আদালত থেকে এ মামলার নথিপত্র তলব ও পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলন নিয়ে চাওয়া ব্যাখার পর চার্জশিট তৈরির ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক হয়ে এগুচ্ছে পুলিশ।
জেলা পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মিন্নিকে মামলায় প্রধান নাকি হুকুমের আসামি করা হবে এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে পুলিশ। এ ব্যাপারে আইনী পরামর্শ নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। হাইকোর্টে রুল জারি ও তলবের আগে মিন্নিকে প্রধান আসামি করে চার্জশিট দেয়ার বিষয়টি প্রায় চুড়ান্ত করা হয়েছিল বলেও পুলিশের ওই সূত্রটি জানায়।
এদিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় নিহতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাকে কেন জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তাকে মামলার নথিপত্রসহ আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জামিন প্রশ্নে রুল শুনানির জন্য ২৮ আগস্ট দিন ধার্য রেখেছেন আদালত। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত মঙ্গলবার দুপুরে এই আদেশ দেন। মিন্নি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার আগে বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন গত ১৮ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তার সংশ্লিষ্টতার কথা জানান। সে বিষয়েও এসপির লিখিত বক্তব্য চেয়েছেন আদালত।
জেলা পুলিশের সূত্র জানায়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা থানার পরিদর্শক হুমায়ন কবির ২৮ আগস্ট উচ্চ আদালতে মামলার নথি উপস্থাপনের জন্য বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহানও। এর আগে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির অভিযোগপত্র তৈরির ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ের মতামত নিতে বেশ কিছুদিন ঢাকায় ছিলেন। তাঁরা বরগুনায় ফিরে যখন অভিযোগপত্র প্রস্তুতের উদ্যোগ শুরু করেন, তখনই উচ্চ আদালত রুল দেন।
মিন্নির হয়ে আইনি সহায়তা দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই মিন্নি ও তাঁর পরিবার প্রতিকূল অবস্থা ও বিভিন্ন চাপের মধ্যে ছিল। স্থানীয় আদালতে তাঁর পক্ষে কোনো আইনজীবীও ছিলেন না। এই অবস্থায় ঢাকা ও বরিশাল থেকে আইনজীবী পাঠিয়ে মিন্নিকে আইনি সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’
মিন্নিকে আসামি করার ব্যাপারে জেড আই খান জানান, রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার প্রধান সাক্ষী আয়শা সিদ্দিকাকে আসামি করা হলে মামলার মান নষ্ট হয়ে যাবে।
মিন্নির পক্ষে বরগুনার আইনজীবী আসলাম হোসেন মনে করেন, মামলায় আয়শাকে আসামি করার জন্য পুলিশ তড়িঘড়ি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিলেও সম্প্রতি উচ্চ আদালত বিষয়টি নিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করায় পুলিশ বিষয়টি নিয়ে এখন অনেকটা সংযত।
এদিকে চার্টশিটভুক্ত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ‘এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের তৎপরতা শুরু থেকেই অব্যহত ছিল। অন্য যারা হত্যাকাণ্ডে সহযোগীতা করেছেন তাদেরকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।’
মিন্নিকে চার্জশিটে আসামি করার ব্যাপারে তিনি জানান, তদন্তে যেভাবে এসেছে সেভাবেই মামলার চার্জশিটে তাকে আসামি করা হবে।