জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন জনাব হাসান রেজা। সেখানেই পরিচয় হয় শ্রীলংকান বংশদ্ভুত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী এক তরুনীর। পরিচয় থেকে ভালাও লাগা, আর ভাল লাগা থেকে ভালবাসা। ভালবাসাকে তারা বিয়েতে রুপান্তরিত করলেন। বিয়ের আগে খ্রিস্টান তরুনী তার নিজ ধর্ম ত্যাগ করেন। ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে! পরিবারের মেনে নেয়ারই কথা নয়। শ্রীলঙ্কায় থাকা সেই তরুনীর পরিবারও মেনে নেয়নি। এরপর থেকেই শ্রীলঙ্কায় পুরো পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তার। এটা ১৯৯৫ সালের কথা।
বিয়ের ঠিক তিন বছর পর স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরেন হাসান রেজা। কারণ স্ত্রী যে তার গর্ভবতী! ১৯৯৮ সালের ৩০ অক্টোবর এই দম্পত্তির ঘর আলো করে আসে এক ফুটফুটে সন্তান। সেই সন্তানই আজকের বাংলাদেশ অনুর্দ্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক সাইফ হাসান। নিজের জীবনের গোপন থাকা বিষয় নিয়ে সাইফ হাসান একান্তে কথা বলেছেন। এ সময়ই জানা গেল সেই লুকিয়ে থাকা গল্প।
বাংলাদেশে জন্ম নিলেও, এরপরই সাইফকে নিয়ে তার বাবা-মা পাড়ি জমায় সৌদি আরবে। দশ বছর বয়স পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গে সেখানে কাটান তিনি। এরপর দেশে ফিরে আসেন। শুক্রবার দিন বাবার অফিসের সবাই যখন ক্রিকেট খেলতো, তখন সে পাশে বসে তা দেখতো। তবে সাইফের ক্রিকেটের সাথে পরিচয় তার সৌদি গৃহ শিক্ষকের হাত ধরে, যে কি না ছিলেন একজন বাঙালি।
ক্রিকেটের সাথে ভালভাবে পরিচয় সম্পর্কে জানাতে গিয়ে সাইফ বলেন, ‘আমাকে সৌদিতে যিনি বাসায় পড়াতেন, তিনি ছিলেন একজন বাঙালি। উনিই আমাকে ক্রিকেটটা ভালভাবে প্রথম বোঝান। আমাকে তিনি একটা ব্যাটও উপহার দেন। আমার প্রথম ব্যাট ছিল সেটা। যেটা দিয়েই বলতে গেলে আমার ক্রিকেটের হাতেখড়ি।’
এ তো সাইফের ছোটবেলার কথা গেল। ক্রিকেটের প্রতি ছেলের ভাল লাগা এবং ভালোবাসা দেখে বাবা হাসান রেজা দেশে চলে আসলেন তাকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য। সৌদি আরবের পর্ব শেষ করে পুরোপুরি দেশেই বসবাস শুরু করলেন। এরই মধ্যে ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর কাজও শুরু করেন। ছেলেকে ভর্তি করান ধানমন্ডির ক্রিকেট কোচিং স্কুলে, আবাহনীর মাঠে বেড়ে উঠেন সাইফ রণজিৎ স্যারের অধীনে।
এরপরই সাইফ ধীরে ধীরে নিজেকে একজন ভালো ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করলেন। সুযোগ পেয়ে গেলেন ২০১৬ সালের যুব এশিয়া কাপের বাংলাদেশ দলে। সেবার আসর বসেছিল তারা নানাবাড়ির দেশ শ্রীলংকায়!
তিনি যথা সময়ে গিয়েছিলেন শ্রীলংকাতে। তারপর যা ঘটেছিল তার বর্ণনা সাইফ নিজের মুখেই দিয়েছেন। তার বর্ণনা হুবহু তুলে ধরা হল। ‘আমরা শ্রীলংকা যাওয়ার পর বোর্ড থেকে আমাদের ওখানকার লোকাল সিম দেয়া হল। হঠাৎ একদিন দেখি সেই নাম্বারে একটা লোকাল সিম থেকে ফোন আসলো। ধরার পর তিনি জানালেন, তিনি আমার খালা হন। তখন আমি জানতে পারি, আমার নানা বাড়ির পরিবারের এই একজনের সাথেই আমার মায়ের যোগাযোগ ছিল। তারপর তিনি দেখা করতে চান। দেশে ফেরার আগে একদিন আমার নানাবাড়ির অনেকে আসেন আমাকে দেখতে। আমি কিছুটা অবাক হয়েছি। তারা আমাকে দেখে বেশ ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল। তাদের সাথে এটাই আমার প্রথম দেখা ছিল। এরপর থেকে দুই পরিবারের দূরত্ব অনেকখানি কমে গেছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই ভিডিও কলে কথা হয় আম্মুর সাথে সবার।’
সাইফের ক্রিকেট খেলা’ই দুই দেশের দুই পরিবারের এত বছরের ছিন্ন থাকা বন্দনকে জোড়া লাগিয়ে দিলো। পরেরবার শ্রীলংকায় খেলতে যাওয়ার সময়ই সাইফের মা এত বছর পর বেড়াতে যান নিজ বাবার বাড়িতে। সে কথা বলতে গিয়ে সাইফের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক।
সাইফ বলছিলেন, ‘এর পরেরবারই আমি যখন শ্রীলঙ্কায় খেলতে যাই তখন আমার ছোট বোন আর মা আলাদা ফ্লাইটে শ্রীলঙ্কা যান। এত বছর পর তিনি ফিরে যান তার নিজের পরিবারের কাছে। বিষয়টা খুব আনন্দের ছিল। আমার ক্রিকেট খেলাটাই এই অনন্দের উপলক্ষ্য এনে দেন।’
সাইফকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করা হল, ‘আপনাকে শ্রীলঙ্কাতে নাকি জোর করে রেখে দিতে চেয়েছিল আপনার নানার পরিবার?’ জবাবে মৃদু হেসে সাইফ বললেন, ‘অনেকেই বিষয়টাকে গুলিয়ে ফেলেছে। এমন কিছুই না। প্রায় ২৫ জনের মত মানুষ একসাথে টিম হোটেলে দেখে সবাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। আর কিছুই না। আর আমার মায়ের কিছুটা ব্যাকগ্রাউন্ড বাংলাদেশেও আছে।’
শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশ অগণিত ভক্ত রয়েছে এই ক্রিকেটারের। দুই দেশেরই রক্ত রয়েছে এই তরুণের শরীরে। খেলছেনও দারুণ। হয়তো একসময় দেশকে ভাল কিছুই উপহার দেবেন, যেমনটা উপহার দিয়েছেন নিজ পরিবারকে।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ