১৪ বছর আগে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ইউরোপের মাটিতে পা রাখেন বাংলাদেশি তরুণ মো. সম্রাট। দীর্ঘদিন সাইপ্রাসে কাটিয়ে ২০১২ সালে তিনি পর্তুগালে আসেন ইউরোপে বৈধ কাগজপত্র পাওয়ার আশায়। কিন্তু তখন কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। পর্তুগালে বৈধ কাগজপত্র পেতে হলে কাজের কন্ট্রাক্ট চালু করতে হয়, কিন্তু নতুন মানুষের কাজ পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিল। তার ওপর চারপাশের মানুষজন ভরসা না দিয়ে উল্টো ভয় ও বিভ্রান্তি ছড়াত। তাই পর্তুগালে প্রথম দিকে চরম হতাশায় দিন কাটে তার।
কিছু দিনের মধ্যে পাশের বাসার প্রতিবেশী, এক সুইস পরিবারের সঙ্গে সক্ষতা গড়ে ওঠে তার। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হতো। মাঝেমধ্যে খোঁজ-খবর নেয়া হতো। একদিন মন খারাপ দেখে তাকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলো পরিবারের সদস্যরা এবং তিনি তার সমস্যার কথা জানালেন। ওদের লিসবনে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা ছিল। সব কথা শুনে তাকে কন্ট্রাক্টসহ একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেয় পরিবারটি। এরপর ছয় মাসের মধ্যে কাগজ পেতে তাকে সাহায্য করেছিল এই পরিবার।
অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি, ঘুরে দাঁড়ালেন যেভাবে: ছয় মাসের মধ্যে পর্তুগালের বৈধতা পেয়ে যান তিনি। কাগজপত্র পেয়ে আর এক মুহূর্ত বসে থাকতে মন চাইলো না তার। সবসময় স্বপ্ন ছিল এক সময় ভালো ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হবেন। নিজে এমন কিছু করবেন, যেন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি অন্যদেরও সহযোগিতা করতে পারেন। প্রথমে একটি পর্তুগিজ স্যুবিনিয়র ও ট্যুরিস্ট শপ করেন তিনি। কিন্তু সফল হননি তিনি, সল্প সময়ের মধ্যে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হন।
শুরুতেই বিশাল এই ব্যবসায়িক ধাক্কার পরও মনবল ভাঙেনি তার। আবার শুরু করলেন নারীর পণ্যসামগ্রীর পাইকারি ব্যবসা, লিসবনের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেটে। প্রথমে ছোট পরিসরে শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে একে একে বিশাল তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন। প্রথম ব্যবসার ক্ষতি ও প্রথম পাইকারি ব্যবসার জন্য দেশ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি।
দীর্ঘদিন গতানুগতিক ব্যবসা করেন এবং এখনও তা চলছে। তাই গত বছরের শুরুতে চিন্তা করলেন একটু ব্যতিক্রম কিছু করা যায় কি না। অনেক চিন্তা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখলেন, পর্তুগাল একটি ট্যুরিজমবান্ধব দেশ। গত বছর প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ পর্তুগাল ভ্রমণ করেছেন এবং বার্ষিক ট্যুরিস্ট প্রবৃদ্ধি হার প্রায় ১৫ শতাংশ। তাই পরিকল্পনা করলেন, এ সেক্টরে কিছু একটা করতে পারলে ভবিষ্যতে ভালো করতে পারবেন।
গতবছর যাত্রা শুরু তার ট্যুরিজম কোম্পানির। প্রাথমিক পর্যায়ে উবার, টেক্সিফাই এবং হোটেল-মোটেলে গাড়ি সরবরাহ করছেন তিনি। পর্তুগালে আগত পর্যটকদের নিয়ে তার বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যটকদের জন্য অভিজ্ঞ গাইড দিয়ে লিসবনসহ পর্তুগালের গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থান ও শহরকে তুলে ধরার পরিকল্পনা তার। পর্তুগালের প্রতি পদে পদে ইতিহাস ও ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। তাই সারা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বেড়াতে যান ওখানে। পর্যটকদের নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এ খাতে।
খুব শিগগিরই এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে তার। একজন পর্যটকের এয়ারপোর্ট পিকআপ থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়া, ঘোরাঘুরি, স্থানীয় মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়সহ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানানো এবং সর্বশেষে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সব দায়-দ্বায়িত্ব তারা পালন করবেন। এ বিষয়ে কম্পানির কর্ম-পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত। আরও কিছু প্রস্তুতি শেষে এ বছরের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ শুরু করবেন তিনি।
প্রথম বাংলাদেশির উদ্যোগে ‘পর্তুগাল মাল্টিকালচারাল একাডেমি’: সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে তুলেছেন পর্তুগালের প্রথম বাংলাদেশির উদ্যোগে ‘পর্তুগাল মাল্টিকালচারাল একাডেমি’। যেখানে পর্তুগিজ সরকার অনুমোদিত, পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষা কোর্স চালু রয়েছে। লেভেল এ-১ এবং এ-২ সমমানের সাটিফিকেট কোর্স, যা পর্তুগিজ নাগরিকত্ব আবেদনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ও অপরিহার্য। বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা এই একাডেমি থেকে তাদের ভাষাগত দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি কর্ম প্রশিক্ষণেরও সুযোগ পাচ্ছেন।
একাডেমিতে চালু রয়েছে ‘লিসবন ওয়ানস্টপ সার্ভিস’,- যেখান থেকে ৯৭টি দেশের অভিবাসীরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও সুবিধা গ্রহণ করে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষা কোর্স ছাড়াও তার একাডেমিতে রয়েছে, অভিজ্ঞ পর্তুগিজ অভিবাসন আইনজীবীর আইনি পরামর্শ, বাংলাদেশি নারী ডাক্তার দ্বারা নারীদের স্বাস্থ্য পরামর্শ, বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল কোর্স, শিশুদের বাংলা স্কুল ও নারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত আছেন তরুণ এই উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব পর্তুগালের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সহযোগিতা করছেন তাদের, যারা নতুন আসছে এ দেশে বৈধ কাগজপত্র পাওয়ার আশায়। আরও কাজ করছেন, বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।
মো. সম্রাট এ বছের শুরুতে গ্রহণ করেছেন পর্তুগিজ নাগরিকত্ব। খুব শিগগিরই পর্তুগালের মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আশা তার। পর্তুগালে বাংলাদেশ কমিউনিটিকে সামনে এগিয়ে নিতে ও অধিকার আদায়ে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।
নতুন বাংলাদেশিদের প্রতি পরামর্শ: পর্তুগালে নতুন বাংলাদেশিদের প্রতি তার পরামর্শ- কখনও অন্যের কথা শুনে পিছু হটবেন না। এখানে দুদিন আগে বা পরে বৈধ কাগজপত্র পেতে পারেন, যদি লেগে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে আপানাকে জীবনের জোয়ার-ভাটার সম্মুখীন হতে হবে। এতে নিজেকে না গুটিয়ে ভুল-ত্রুটি শুধরে নতুন করে পথ চলতে হবে। তাহলে আপনার জীবনে সফলতা ধরা দেবে। সবসময় নিজের বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। অন্যের থেকে শুধু পরামর্শ নেবেন কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে নিজেকে, তাহলে প্রবাসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ