চট্টগ্রাম নগরীতে একবছর আগে বৃদ্ধা নারী ও তার ব্যাংক কর্মকর্তা মেয়েকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় ওই বৃদ্ধার এক ছেলে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া দুজন আসামি জবানবন্দি দিয়ে জানিয়েছে, আমেরিকা প্রবাসী মাসুদুর রহমান দেশে ফিরে তার মা ও বোনকে হত্যার মিশনে অংশ নিয়েছে। হত্যার পর মাসুদ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া অন্যদের কোরআন ছুঁয়ে শপথ করায়, যাতে এই ঘটনা প্রকাশ না করে। গ্রেফতার দুজন হলেন হারুন অর রশিদ মুন্না (৩৯) ও তার গাড়িচালক মো. মাহফুজ (২৮)।
শনিবার (২৫ মে) বিকেলে দুই আসামি চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মেহনাজ রহমানের আদালতে জবানবন্দি দেন। শুক্রবার (২৪ মে) রাতে দুজনকে নগরীর টাইগারপাস এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. ইলিয়াছ খাঁন।
পুলিশের পরিদর্শক ইলিয়াছ বলেন, ‘গ্রেফতারের পর দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এবং জবানবন্দিতে পাওয়া গেছে যে, মা-মেয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্য অর্থাৎ ছেলে মাসুদুর রহমান জড়িত। আমেরিকা থেকে দেশে এসে মা ও বোনকে খুন করে পরদিন আবার চলে গেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। আমরা মাসুদুর রহমানের পাসপোর্ট নম্বরসহ আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন তার দেশে প্রবেশ এবং আবার আমেরিকার ফিরে যাওয়ার তথ্য যাচাই করে দেখতে হবে।’
২০১৮ সালের ১৫ জুলাই খুলশী থানার আমবাগান এলাকার মেহের মঞ্জিল নামে একটি ভবনের পানির ট্যাংক থেকে ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা (৬৭) ও তার ৯৪ বছর বয়সী মা মনোয়ারা বেগমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মনোয়ারার সেজ ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে খুলশী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইলিয়াছ বলেন, ‘২০১৪ সালের ১৪ মার্চ মাসুদুর রহমান আমেরিকায় যান। তাকে আমেরিকায় পাঠানোর সব ব্যবস্থা করেন বড় বোন মেহেরুন্নেসা, যিনি অবিবাহিত। কিন্তু আমেরিকায় যাওয়ার আগে মেহেরুন্নেসা মাসুদুরের কাছ থেকে তার সম্পত্তি নিয়ে নেয়। মাসুদুর প্রথমে বিয়ে করে এক পাকিস্তানি নাগরিককে। কিন্তু মেহেরুন্নেসার পছন্দ না হওয়ায় তাকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। পরে মাসুদুর আবার খুলশীতে তাদের বাড়ি ফেরতের পাঁয়তারা করেন। আরও কিছু বিষয় আছে। সবমিলিয়ে বোনের ওপর ক্ষোভ থেকে তাকে খুনের সিদ্ধান্ত নেয়। বোনকে খুন করতে গিয়ে মাকেও মেরে ফেলে, এমন তথ্য আছে আমাদের কাছে। তবে সেটা আরও যাচাই করতে হবে।’
হত্যাকাণ্ডের আটদিন পর মেহেরুন্নেসার ভাইপো ও মনোয়ারার নাতি মুশফিকুর রহমানকে (৩২) গ্রেফতার করা হয়েছিল। মুশফিক মনোয়ারার মেজ ছেলে মতিউর রহমানের সন্তান। ২০০৪ সালে মতিউর মারা যাওয়ার পর মুশফিকের মাকে বিয়ে করেন তার সেজ চাচা মোস্তাফিজুর রহমান। হত্যাকাণ্ডের পর এই মোস্তাফিজুর রহমান বাদি হয়ে থানায় মামলা করেছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর মেহেরুন্নেসা ও মনোয়ারার কাছে বড় হন মুশফিক। কিন্তু তাদের অমতে বিয়ে করায় তাকে মেহের মঞ্জিল ছাড়তে হয়েছিল। এ নিয়ে দাদি-ফুপুর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইলিয়াছ বলেন, ‘মুশফিক বখে গিয়েছিল। এজন্য মেহেরুন্নেসা তার মাকে দায়ী করেছিলেন। কারণ মা মুশফিককে রেখে দেবরকে বিয়ে করেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের আগে মুশফিকের মাকে মারধর করেন মেহেরুন্নেসা। মুশফিক এ বিষয়ে আমেরিকায় চাচা মাসুদুরের কাছে বিচার দিয়েছিল। মাসুদুরও এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে মুশফিকুরকে উসকানি দিয়ে ফুপুর উপর ক্ষুব্ধ করে।’
এই ঘটনায় মো. মুসলিম (২৫), মেহেরুন্নেসার প্রতিবেশী মো. মাসুদ রানা (৩৯) ও বিএনপি নেতা মো. শাহাবউদ্দিন ওরফে সাবু ওরফে মুছাকে (৩৭) গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর গ্রেফতার হওয়া মুন্না মুশফিকের তালাক দেওয়া স্ত্রীর ভাই।
সূত্রমতে, আদালতে দেওয়া মুন্না ও মাহফুজের জবানবন্দিতে এসেছে- শাহাবউদ্দিন সাবু’র বাসায় বসে ছয়জন মিলে হত্যার পরিকল্পনা হয়, যার মধ্যে মাসুদুর ও মুশফিকও ছিল। মাসুদুরের পরিকল্পনা ছিল- মায়ের কাছ থেকে খুলশীর ওই বাড়ির দানপত্র আদায় করা। তারপর শাহাবউদ্দিন সাবু’র মাধ্যমে সেটি তিন কোটি টাকায় বিক্রির কথা ছিল। মা ও বোনকে খুন করতে পারলে সেটি সহজে দখলের পরিকল্পনা থেকে তারা এই ঘটনা ঘটায়।
হত্যাকাণ্ডের ওই রাতে সাড়ে ১২টার দিকে মাসুদুর নিজেই বাসার দরজায় টোকা দিলে মেহেরুন্নেসা দরজা খুলে দেয়। এ সময় মেহেরুন্নেসা বলেন, ‘তুই বিদেশ থেকে হঠাৎ দেশে কেন?’ এসময় মাসুদুর মেহেরুন্নেসার কাছ থেকে সম্পত্তির দুটি দলিলে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মেহেরুন্নেসা স্বাক্ষর দিতে না চাইলে তাকে গলাটিপে ধরে এবং মুশফিক পিঁড়ি দিয়ে তার ফুপুর মাথায় আঘাত করে। সবাই মিলে তাকে হত্যা করে লাশ ট্যাংকে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর মেহেরুন্নেসার মা মনোয়ারাকে হত্যার জন্য মাসুদুরের নেতৃত্বে সবাই তার কক্ষে ঢোকে। মাহফুজসহ কয়েকজন মাকে হত্যা না করার অনুরোধ করলে মাসুদুর বলে- ‘এই বুড়িকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই।’
এরপর মনোয়ারার হাত বেঁধে তাকে সিঁড়ির কাছে আনার পর তিনি চিৎকার দিলে শাহাবউদ্দিন সাবু তার পেটে লাথি মারে। মাসুদ তার গলা টিপে ধরার জন্য মুসলিমকে (পরে গ্রেফতার) নির্দেশ দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মনোয়ারার লাশও ট্যাংকের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা ইলিয়াছ বলেন, ‘দুজনকে হত্যার পর মাসুদুরের নির্দেশে সকলে কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে যাতে কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নিজের নাম ছাড়া অন্য কারো নাম না বলে। আদালতে জবানবন্দিতে এই তথ্যও এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘এই পর্যন্ত যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে যেসব তথ্য আমরা পেয়েছি সেগুলো হচ্ছে- মেহেরুন্নেসার ওপর পরিবারের সদস্যদের ক্ষোভ ছিল। তাদের ঘরে দুই ভাই, ভাইয়ের ছেলে, ভাইয়ের স্ত্রী- এদের একাধিক বিয়ে। এসবের পেছনে মেহেরুন্নেসা। তিনি তার মতের সঙ্গে না মিললে তাদের গ্রহণ করতেন না। হয়ত সেটা ভালোর জন্য, কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা সেটা ভালোভাবে নেননি। এছাড়া খুলশীতে মেহেরুন্নেসার দখলে থাকা সম্পত্তির উপর পরিবারের সদস্যদের লোভ ছিল। বাইরের কিছু ব্যক্তিও তাদের বিরোধের সুযোগে ঢুকে পড়েছিল।’