পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আওতাধীন গ্রিনসিটি প্রকল্পের বালিশ কাণ্ডের হোতা এবং প্রত্যাহার হওয়া নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন, অবৈধ অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগ উঠছে। এছাড়া মাসুদুলের ছোট ভাই আমেরিকা প্রবাসী মাহমুদুল আলম সোহেলের বিরুদ্ধেও প্রতারণার মাধ্যমে তিন বিয়েসহ অসংখ্য পরকীয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সোহেলের স্ত্রীর অভিযোগের সূত্র ধরে জানা যায়, নিজেকে ক্ষমতাধর পরিচয় দেয়া এ প্রকৌশলীর পরিবার নারী নির্যাতনের সঙ্গেও জড়িত। অভিযোগ প্রসঙ্গে তার আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সেলিনা আক্তার বলেন, ‘আমাকে নির্যাতনসহ পরবর্তী সবকিছুর পরামর্শদাতা হিসেবে দায়ী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম। তিনি শুধু আমাকে নন, তাদের পরিবারের অপকর্মের বিচার চাওয়ায় আমার ভাইকেও হুমকি দেন। এ নিয়ে ২০১৮ সালে টাঙ্গাইল থানায় মামলা করেন আমেরিকা প্রবাসী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম সোহেলের স্ত্রী সেলিনা আক্তারের পক্ষে তার ভাই মো. হুমায়ুন কবির।’
মামলার তথ্য সূত্রে জানা যায়, মাসুদুলের আমেরিকা প্রবাসী ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ২০১১ সালে বিয়ে হয় ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শান্তিনগর এলাকার সেলিনা আক্তারের। বিয়ের পর সেলিনা আমেরিকা চলে যান এবং জানতে পারেন এর আগেও সোহেল দুটি বিয়ে করেছিলেন। তার চরিত্রগত সমস্যার কারণে ওইসব বিয়ে টেকেনি। বিয়ের পর সেলিনার কাছে এসব বিষয় ধরা পড়ে। এছাড়া একাধিক মেয়ের সঙ্গে সোহেল হাতেনাতে ধরা পড়লেও বারবার মাফ চেয়ে ভালো হওয়ার প্রতিজ্ঞা করলে তিনি (সেলিনা) তা মেনে নেন।
এরই মধ্যে সেলিনাকে বিভিন্নভাবে টাকা (যৌতুক) দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন সোহেল। টাকা না দিলেই মারধর করতেন। সেলিনাও বাধ্য হয়ে নিজের সব টাকা সোহেলের হাতে তুলে দেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দেশে আসেন সেলিনা ও সোহেল। দেশে এসে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার নাললারা বাজারের গ্রামের বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে দুদিনের জন্য যান প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের কর্মস্থল পাবনায়।
সেলিনার অভিযোগ, সেখানে প্রকৌশলী মাসুদুল আলম তাদের সাংসারিক বিষয় ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করেন এবং তার কাছে তাদের আলোচনা সন্দেহজনক মনে হয়। সেখান থেকে আবার বাড়ি আসার পর পরিবারের সবাই মিলে বিভিন্নভাবে সেলিনাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন এবং একপর্যায়ে সেলিনাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন।
এরপর সেলিনা ঢাকায় তার মামার বাসায় ওঠেন। একদিন ঢাকা থেকে শ্বশুরবাড়ি ফিরে পরিবারের সবার উপস্থিতিতে সোহেল ও তার মামাতো বোনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। সোহেলের এমন কাণ্ডে সেলিনা প্রতিবাদ করলে মাসুদুল আলমের পরিবারের সবাই তাকে মারধর করেন। সোহেল এ সময় তার গায়ে পেপার স্প্রে মারেন। এতে সেলিনার মুখসহ পুরো শরীর পুড়ে যায়। সেই পোড়া মুখ নিয়ে সেলিনা এখন বাইরে যাওয়াই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
ওই ঘটনার পর স্থানীয় মেম্বারসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সালিশ-বৈঠক করে বিষয়টি মিটমাট করেন এবং সংসার রক্ষার স্বার্থে সেলিনা তা মেনে নেন। এরপর সেলিনা আমেরিকা চলে যান। কিন্তু আমেরিকা গিয়ে সোহেলের ল্যাপটপে সাদিয়া আলম নিপা নামে আরেক মেয়ের সঙ্গে তার (সোহেল) অন্তরঙ্গ ভিডিও দেখতে পান। বিষয়টির সত্যতা জানতে নিপার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে সোহেল ফের সেলিনাকে মারধর করেন। পরবর্তীতে সেলিনা সিদ্ধান্ত নেন আলাদা থাকার। দেশে সেলিনার ভাই নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে টাঙ্গাইলে প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের মা, বাবা এবং ছোট ভাইকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
সেলিনার অভিযোগ, মামলার পর নিজের অবৈধ টাকা ব্যবহার করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় সেখানে প্রভাব বিস্তার করা হয়। উল্টো তার (সেলিনা) পরিবারকে হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের পক্ষ নিয়ে একমাত্র ভাইকে আসামি রেখে বাকিদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেন বলেও সেলিনার অভিযোগ।
সেলিনার ভাই মো. হুমায়ুন কবির জানান, অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নিজেদের পক্ষে নিয়েছেন মাসুদুল আলম। এ কারণে শুধু সোহেলের নাম রেখে বাকিদের নাম বাদ দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘আমার বোনের মামলার জন্য টাঙ্গাইল গেলে আমাকে কয়েকবার হুমকি দেয়া হয় এবং ফোনে প্রায়ই গালাগালি করা হয়। মামলার তদন্ত প্রভাবিত করেছেন প্রকৌশলী মাসুদুল আলম।’
তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই (পিবিআই) আশরাফ উদ্দিন। তিনি জানান, তদন্তে শুধু মাহমুদুল আলম সোহেলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। পরিবারের অন্যদের সংশ্লিষ্টতা না থাকায় নাম বাদ দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এ মামলায় প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের ভাই মাহমুদুল আলম সোহেলের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে, যা স্থানীয় থানা তদারকি করছে।
অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট থাকা সত্ত্বেও এখনও কেন সোহেলকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না- এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে সাইদুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘ওয়ারেন্টভুক্ত যে কোনো আসামিকে পুলিশ তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কারণ একজন এএসআইকে মাসে তিনটি এবং এসআইকে মাসে দুটি ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে গ্রেফতারের টার্গেট দেয়া থাকে। অনেক সময় আমিও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি খোঁজার অভিযানে থাকি। মামলাটি ২০১৮ সালের, তখন আমি এ থানায় ছিলাম না। তা-ই আমার নলেজে নেই।
‘তবে এক্ষেত্রে যদি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট থেকেই থাকে তা হলে নিশ্চিত আসামিকে খোঁজা হচ্ছে। তবে আসামি এ এলাকায় আছে কি-না, সেটাও দেখার বিষয়’- যোগ করেন তিনি।
মাসুদুল আলমের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থপাচারের অভিযোগ: প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থপাচারেরও অভিযোগ উঠেছে। ‘তিনি বেশ কয়েকবার বিদেশে টাকা পাচার করেছেন’- জানিয়ে সেলিনা আক্তার বলেন, নিজেই ভাইয়ের অপকর্মের প্রশ্রয়দাতা মাসুদুল। ২০০৯ সালে ১২ হাজার ডলার পাচার করেন আমেরিকায়। চরিত্রহীন ছোট ভাইকে প্রথম স্ত্রীর মামলা থেকে বাঁচাতে অবৈধ পথে এ টাকা পাঠান তিনি।
সেলিনা আক্তার আরও জানান, প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায়, যা তার নিকটাত্মীয়দের নামে। শুধু বোনের নামে ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার দাম এক কোটি টাকার ওপর। বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট আছে স্ত্রীর নামে। আমেরিকায় ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে প্রচুর টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
অভিযোগ আছে, তক্ষকের মাধ্যমে যে অবৈধ ব্যবসার একটি সিন্ডিকেট কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠেছিল প্রকৌশলী মাসুদুল আলম তার সঙ্গেও জড়িত। তিনি এতই ক্ষমতাবান ছিলেন যে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। অবৈধ অর্থের জোরেই তিনি এমনটি করতে পেরেছেন।
তবে বালিশ কাণ্ডে প্রকৌশলী মাসুদুল আলমকে গত বুধবার (২২ মে) প্রত্যাহার করার পর তার সঙ্গে সখ্যতার খবর সবাই অস্বীকার করছেন। তার প্রত্যাহারের বিষয়টি এর আগে নিশ্চিত করেন গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. শাহাদাৎ।
এ বিষয়ে প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের মোবাইলে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ