সুইডেনের মুসলমানরা এবারের পবিত্র রমজানের রোজা পালন করছেন প্রায় ২১ ঘণ্টা। সুইডেনের কোনো কোনো এলাকায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় ২১ ঘণ্টা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে সময় সীমা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি।
মজার ব্যাপার হলো, সুইডেনেই আবার কোনো কোনো সময় দিনের সময়-সীমা খুবই কমে যায়। তখন দিনের পরিধি হয় মাত্র দুই-এক ঘণ্টা। সূর্যোদয় হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য আবার অস্ত যায়। একই অবস্থা ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড। তবে কাছাকাছি সময়ের এই সূর্যোদয় ও অস্ত দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে এসব দেশে। সেসময় রোজা রাখা খুবই আরামের।
রমজান মাস ঘুরে ফিরে যখন ডিসেম্বর মাসে আসবে, তখন দুই-এক ঘণ্টার ব্যবধানে রাখা যায় রোজা। তবে এসব দেশে বসবাসরত অনেকে ২২/২৩ ঘণ্টা কিংবা ১/২ ঘণ্টা রোজা না রেখে রোজা রাখেন পবিত্র মক্কা শরীফের সময় অনুযায়ী। আবার কেউ কেউ পাশ্ববর্তী মুসলিম দেশের নিয়ম অনুসারেও রোজা রেখে থাকেন। কোন নিয়মে রোজা রাখা দরকার, তা নিয়ে সে দেশের মুসলিম স্কলারদের মাঝে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। তবে সুইডেনের মুসলমানদের জন্য এই দীর্ঘ সময় সীমার রোজা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনা। এমনটাই জানালেন সেদেশের অধিকাংশ মুসলমান।
‘আন্না’ নামের একজন যুবতী বেশ কয়েক বছর আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘ইসলামধর্ম গ্রহণ করার পর এটা আমার ষষ্ঠ রমজান। প্রথম যখন রোজা রাখি, তখন আমার ধারণা ছিল, দীর্ঘ সময় পানাহার থেকে বিরত থাকার কারণে আমি অসুস্থ হয়ে পড়বো। কিন্তু যখন রোজা রাখলাম, তখন বুঝলাম বিষয়টা সম্পূর্ণই উল্টো। দীর্ঘ সময় রোজা রাখা দুঃসাধ্য মনে হলেও আমরা রোজা রাখছি। এতে আমরা কোনো সমস্যা বোধ করছিনা।
আন্না আরো বলেন, এবারের রমজানে সিয়াম পালনে সবচেয়ে বেশি সময় দিতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান রমজানের রোজা পালনের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন এবং তারা রমজান মাসকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভের কারণ মনে করেন। রমজানকে তারা দ্বীন সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়ানো ও জ্ঞান সমৃদ্ধ করার মোক্ষম সুযোগ মনে করেন।
সুইডেনে গ্রীষ্ম কালে দিন সবচেয়ে বেশি লম্বা হয়ে থাকে। তখন রাত হয় মাত্র তিন ঘণ্টা। আর বাকি ২১ ঘণ্টাই দিন। কিন্তু ‘আন্না’ রোজা রাখতে কোনো সমস্যা বোধ করেন না। তিনি বলেন, আমি স্টকহোমে আসার আগে উত্তর সুইডেনের উমিয়ায় বসবাস করতাম। সেখানে দিন অনেক দীর্ঘ। তা সত্ত্বেও আমি বিগত বছরগুলো রোজা রেখেছি। এটি আমার জীবনের ষষ্ঠ রমজান। ইতিপূর্বের সবগুলো রমজানেই আমি এরকম দীর্ঘ সময় রোজা রেখে অভ্যস্ত।
তবে এখানে অতিবৃদ্ধ, অসুস্থ, গর্ভবর্তী-নারী ও দুগ্ধদানকারী নারীরা সাধারণত ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী রোজা ছেড়ে দেন। কেননা ইসলাম নিজেদের ও বাচ্চাদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলার অনুমতি দেয় না। অবশ্য এবছর ‘আন্না’ও রোজা রাখবেন না। তিনি বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে শুধু গত বছর রোজা ছেড়েছি আর এ বছর ছাড়ছি। কেননা গত বছর আমি ছিলাম গর্ভবর্তী। আর এ বছর আমি আমার সন্তানকে দুধ পান করাই। তাই সন্তানের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাইনা। আর ইসলাম আমাদের ওজরের কারণে সাময়িকভাবে রোজা ছাড়ার অনুমতি দিয়েছে। সন্তানের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রতি ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করেছে।
ডা. মিরিয়াম ইলবিরনসন ডায়াবেটিস ও এন্ডোক্রিনলজি বিশেষজ্ঞ। পাশাপাশি তিনি ইউতি উবুরি শহরের ‘লুনদিবি’ ক্লিনিকের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, গর্ভবর্তী ও দুগ্ধদানকারিণী মায়েদের জন্য সুইডেনের এই লম্বা সময়ের রোজা থেকে বিরত থাকা উচিত। আর ইসলামি শরিয়তও রোজা ছেড়ে দিতে অনুমতি দেয়। পরবর্তীতে সমস্যা চলে যাওয়ার পর কাজা করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে ডা. মিরিয়াম ইলবিরনসন সুস্থদের জন্য দীর্ঘ সময়ের দিনে রোজা রাখতে কোনো সমস্যা নেই বলে মন্তব্য করেন।
সুইডেনের মতো আরও অনেক দেশে দীর্ঘ সময় রোজা রাখেন স্থানীয় মুসলিমরা। যেমন, আইসল্যান্ডে ২২ ঘণ্টা, আলাস্কায় ১৯ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট, জার্মানিতে ১৯ ঘণ্টা, ইংল্যান্ডে ১৮ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট, কানাডায় ১৭ ঘণ্টা ৭ মিনিট ও তুরস্কে সাড়ে ১৭ ঘণ্টা।
রেডিও সুইডেন অবলম্বনে মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব, মুহাদ্দিস ও সাংবাদিক