অল্প খরচে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে উচ্চ বেতনে বিদেশে কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে, দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে পাচারকারী চক্র। এ চক্রের সদস্যরা বেশ কয়েকটি এজেন্সির মাধ্যমে গ্রামের অল্প শিক্ষিত লোকদের মাত্র ৮ লাখ টাকায় ইউরোপে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনটি রুট ব্যবহার করে ইউরোপে মানবপাচার করত। অবৈধভাবে ইউরোপে পাঠানোর সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশী নিহতের ঘটনায় জড়িত চক্রের তিন সদস্য সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে এসব তথ্য দেন র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান।
র্যাব জানায়, এই মানবপাচারকারী চক্রটি ইউরোপ পাঠানোর জন্য ৮ লাখ টাকা করে নেয়। যার পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়া যাওয়ার আগে এবং বাকি তিন লাখ টাকা লিবিয়া যাওয়ার পর ভিকটিমের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নিচ্ছে। উন্নত জীবনের লোভে নৌকায় ভূমধ্যসাগরে ইউরোপ যাওয়ার সময় ভিকটিমদের ত্রিপোলিতে বাংলাদেশী ‘গুডলাক’ দালালরা গ্রহণ করে। ভিকটিমরা তাদের ‘গুডলাক’ বা ‘গুডলাক ভাই’ নামেই ডাকে।
মানবপাচারের সাথে জড়িত দেশজুড়ে অন্তত ১০-১৫টি চক্রের তথ্য পেয়েছে র্যাব। যার মধ্যে পাঁচ-ছয়টি চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া বাংলাদেশীরা ৯ মে নৌদুর্ঘটনায় পতিত হন।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দু’টি পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১। তারা হলেন- আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া (৩৪)।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, গত ৯ মে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবিতে প্রায় ৮৫-৯০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশী ছিলেন ৩৯ জন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্বজনেরা শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় দু’টি মামলা করেন। ওই মামলার ছায়া তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুইটি চক্রের তিনজনকে আটক করা হয়। তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। তারা প্রথমে বিদেশে গমনেচ্ছুক নির্বাচন করে, এরপরের ধাপে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং সর্বশেষ ধাপে লিবিয়া থেকে তাদেরকে নৌপথে ইউরোপে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ইউরোপে পৌঁছে দিতে তারা সাত-আট লাখ টাকা অর্থ নির্ধারণ করে, যার মধ্যে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এর মধ্যে বেশির ভাগ টাকা পরিশোধ হয়ে যায়, যার ফলে ইচ্ছা থাকলেও আর ফেরত আসতে পারেন না ভুক্তভোগীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে পাচারে তিনটি রুট ব্যবহৃত হয় জানিয়ে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, রুটগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ-ইস্তাম্বুল (তুরস্ক)-লিবিয়া, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা (চার-পাঁচ দিন অবস্থান)-ইস্তাম্বুল (ট্রানজিট)-লিবিয়া এবং বাংলাদেশ-দুবাই (সাত-আট দিন অবস্থান)- আম্মান (জর্দান) (ট্রানজিট)-বেনগাজী (লিবিয়া)-ত্রিপলি (লিবিয়া)। এ ক্ষেত্রে তারা সড়ক পথ ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়া পৌঁছ তো। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনেশিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাচার করে থাকে।
ভিকটিমরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশী কথিত ‘গুডলাক ভাই’সহ আরো কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকে। তাদেরকে ত্রিপলিতে বেশ কয়েকদিন রাখা হয়। এ সময়ে তারা ভিকটিমদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে।
সেখানকার সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা এবং দিকনির্ণয় যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোরে এক সাথে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনেশিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে গমনকালে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
মুফতি মাহমুদ বলেন, গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ বাংলাদেশীরা সিলেট, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীর বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তারা পাঁচ-ছয়টি চক্রের মাধ্যমে ইউরোপে যাচ্ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আটক তিন সদস্যের চক্রের মাধ্যমে কতজন সেখানে গিয়েছিলেন বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। তাদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ ছাড়া, দেশজুড়ে ১০-১৫টি চক্রের খবর আমরা পেয়েছি। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।