Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

srilanka-muslimইস্টার সানডেতে কলম্বোর কয়েকটি চার্চ ও চারটি হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর তাৎক্ষণিক মানসিক আঘাত ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠার পর শ্রীলঙ্কায় যে কঠিন উপলব্ধি তৈরি হয়েছে তা হলো, সব দিন একইরকম যায় না। দশটি বছর কোনো বোমা বিস্ফোরণের আতঙ্ক ও নিরাপত্তা তল্লাশির বিড়ম্বনা ছিল না। কিন্তু দেশটি আবার জরুরি অবস্থায় ফিরে গেছে।

২১ এপ্রিলের হামলার পর এ জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ফলে নিরাপত্তা বাহিনী যেকোনো স্থানে তল্লাশি চালাতে এবং যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। আট হামলাকারীর সবাই মুসলিম এবং সারা দেশে, বিশেষ করে কাথানকুডিটে চরমপন্থী আদর্শের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। ফলে দেশের ১০ শতাংশ মুসলমানকে ক্ষুব্ধ না করে, ঢালাওভাবে সবাইকে চরমপন্থী বিবেচনা না করে, চরমপন্থা থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সেই চিন্তায় বিভোর গোটা দেশ।

chardike-ad

ধর্মীয় অনুভূতিকে ভুল করে ‘চরমপন্থা’ মনে করা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যেমন, পবিত্র কুরআন বা একই ধরনের ধর্মীয় সামগ্রী বহনকারী অথবা মাদরাসায় কুরআন হেফাজতকারীদের চরমপন্থী হিসেবে সন্দেহ করা। এরই প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কায় ক্যাথলিক চার্চের প্রধান আর্চবিশপ ম্যালকম রঞ্জিত সব ধরনের অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে শুধু মুসলমান নয়, সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তা তল্লাশি চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

তুচ্ছ ও ভিত্তিহীন প্রমাণে আটক সত্যিকারের নিরীহ লোকজনকে কিভাবে সহায়তা করা যায় সেই আলোচনা শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা মুসলিম কংগ্রেসের (এসএলএমসি) মতো রাজনৈতিক দল। বিষয়টি প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনার কাছে উত্থাপনের পরিকল্পনা করেছ এসএলএমসি ও এর আইনজীবীরা। তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সত্যিকারের সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক ম্যাকানিজম তৈরির বিষয়ে তারা আলোচনা করবেন।

এ ছাড়া বাত্তিকালোয়া জেলার ‘শরিয়াহ বিশ্ববিদ্যালয়’ বিষয়ে তদন্তকাজ প্রায় শেষ করে এনেছে কমিটি অন পাবলিক এন্টারপ্রাইজ (সিওপিই)। পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির গভর্নর এম হিজবুল্লাহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা। সৌদি আরবের তহবিলে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ওহাবি-সালাফি ধারার ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করে শিক্ষা দেয়া হয় এবং মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি উন্মুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ রাখার পক্ষে অনেকে।

ইসলাম যে সন্ত্রাস সমর্থন করে না এবং শান্তিতে বিশ্বাসী ধর্ম, তা তুলে ধরতে কর্তৃপক্ষের সাথে কিভাবে কাজ করা যায় তা নিয়ে শ্রীলঙ্কার সুফি মুসলমানেরা আলোচনা শুরু করেছেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। তামিল ও মুসলিম অধ্যুষিত বাত্তিকালোয়া জেলায় ওহাবি-সালাফি ধারার ইসলামের বিস্তার ঘটার আগে শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা মূলত সুফি ধারার ইসলামের অনুশীলন করে আসছিলেন। এখনো বাত্তিকালোয়ার সুফি মুসলমানেরা বলছেন, যে তারাই ধর্মীয় চরমপন্থার প্রথম শিকার, যা গত ৩০ বছরে কাথানকুডিতে মাথা চাড়া দিয়েছে। একে মুসলিমদের ‘অভ্যন্তরীণ ইস্যু’ বিবেচনা করে নিরাপত্তা বাহিনী তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ দিকে জুমার খুতবাসহ ধর্মীয় সমাবেশগুলোর সব ধরনের বক্তব্য রেকর্ড করে সরকারের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে মুসলিমবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে মন্ত্রণালয় থেকে সব মসজিদের ট্রাস্টিদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যেন তারা কোনো ধরনের চরমপন্থী বা ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্য প্রচারের জন্য এমন কোনো সমাবেশ বা জমায়েতের অনুমতি না দেন এবং নিজেরা এতে জড়িত না হন। এই নির্দেশ অমান্য করলে পুরো ট্রাস্টি বোর্ডকে দায়ী করা হবে।

এ দিকে ইস্টার সানডে সন্ত্রাসী হামলা তদন্তের জন্য একটি পার্লামেন্টারি কমিটি গঠনের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে এবং পার্লামেন্টের সব দলের সই করা এই প্রস্তাব স্পিকার কারু জয়সুরিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্পিকার সর্বোচ্চ ১২ সদস্যের এই কমিটি গঠন করবেন যাদের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা থাকবে। তারা যেকোনো ব্যক্তি ও নথিপত্র তদন্ত করতে পারবেন, সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, দেশের যেকোনো স্থানে বৈঠকের আয়োজন, প্রয়োজনী সব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। পার্লামেন্ট অনুমোদন দেয়ার পর তিন মাসের মধ্যে এই কমিটি রিপোর্ট পেশ করবে।

তা ছাড়া শ্রীলঙ্কায় আইএসের সাথে সংশ্লিষ্ট চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এমপি ও জাথিকা হেলা উরুমায়া দলের নেতা অথুরালিয়ে রাথনা থেরা একটি ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা পেশ করেছেন। ২১ এপ্রিলের হামলাকারীরা আইএসের আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। শ্রীলঙ্কা ন্যাশনাল কাউন্সিলের (এসএলএনসি) নামে এই পরিকল্পনায় বলা হয় যে এলটিটিইর তিন দশকে দেশ যে ধরনের হুমকি মোকাবেলা করেছে সন্ত্রাসবাদের নতুন হুমকি সেরকম নয়। ফলে এলটিটিইকে মোকাবেলার জন্য উদ্ভাবিত কৌশল চোখ বুজে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা যাবে না।

এলটিটিই আলাদা ভূখণ্ডের জন্য লড়েছে কিন্তু বর্তমান হুমকি এসেছে একটি বৈশ্বিক সংগঠনের কাছ থেকে, যা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। তাই এই পরিকল্পনায় নতুন সন্ত্রাসের হুমকি কাটিয়ে ওঠার জন্য পশ্চিমের সহায়তা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। তবে এটাও বলা হয় যে জাতীয় নিরাপত্তার সাথে আপস না করেই দেশকে তা করতে হবে। এই সুযোগে কোনো বিদেশী রাষ্ট্র যেন শ্রীলঙ্কায় পা রাখার সুযোগ না পায় তার ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা রাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্ক সামাল দেয়ার প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করা হয়।

থেরার এই কৌশলে আরো উল্লেখ করা হয় যে,সমুদ্র ও বিমানবন্দর কোনো বিদেশী সত্তার কাছে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। বিদেশী সহায়তায় কলম্বো ও ত্রিনকোমালির মধ্যে করিডোর নির্মাণ বন্ধ রাখারও আহ্বান জানানো হয়। মোট কথা জাতীয় ঐক্য জোরদারের জন্য সরকারের প্রতি কঠোর অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। সুপারিশমালার শেষভাগে সব ধরনের সম্প্রদায়গত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বহু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর ও আন্তঃধর্মীয় স্টাডি কোর্স চালু করার আহ্বান জানানো হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মভিত্তিক পোশাক, ধর্মভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ধর্মভিত্তিক আইন ও ধর্মভিত্তিক বসতিরও বিরোধিতা করা হয় ওই পরিকল্পনায়।

সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর