হঠাৎ করে দাড়ি রাখা ও টাখনুর উপর কাপড় পরা শুরু করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন পালন, গান বাজনাসহ পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতে নিজেকে গুটিয়ে রাখাসহ বেশকিছু বিষয়কে জঙ্গিবাদের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে সম্প্রীতি বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন। রোববার দেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্য সনাক্তকরণের ২৩টি উপায় জানিয়ে এই বিজ্ঞাপন দেয় সংগঠনটি।
এদিকে বিজ্ঞাপনে সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্য সনাক্তকরণের যেসব ইন্ডিকেটর দেয়া হয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ধর্মপ্রাণ মানুষেরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে অনেককে। আর আলেম-ওলামারা মনে করেন, এমন বিজ্ঞাপন প্রচার কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার করা হচ্ছে। সম্প্রীতি বাংলাদেশের নামের এই সংগঠনটি গত বছরের ৭ জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির আহ্বায়ক অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে বলছে- বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছাত্ররা জঙ্গি মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জঙ্গি হামলা ও টার্গেটেড কিলিং মিশনে অংশগ্রহণ করে শহীদের মর্যাদা প্রাপ্তির ভুল নেশায় ডুবে রয়েছে। এ রেডিক্যাল ইয়ুথ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে উচ্চ শিক্ষা/উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে রিক্রুটারদের মাধ্যমে কৌশলে ব্রেইন ওয়াশের শিকার হচ্ছে এবং পরবর্তীতে জঙ্গি সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছে ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে গমন করে জঙ্গি আক্রমণের পরিকল্পনা ও আত্মঘাতী হামলার অংশগ্রহণ করছে।
এ সকল জঙ্গি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ, নজরদারি, ব্যক্তিগত প্রোফাইল দীর্ঘদিন ধরে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে রেডিক্যাল ইন্ডিকেটরসমূহ ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞাপনটিতে সন্দেহভাজন জঙ্গি চেনার যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেয়া হয়েছে তার কয়েকটির মধ্যে রয়েছে- একাডেমিক পড়াশুনার প্রতি অমনযোগিতা ও ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশুনা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি, আত্মকেন্দ্রিক (ইন্ট্রোভার্ট), অতিমাত্রায় চুপচাপ, গভীরভাবে চিন্তামগ্ন এবং ধর্মীয় উপদেশমূলক কথাবার্তা বলা, রুমের মধ্যে বেশিরভাগ সময় একাকী থাকা ও তার কার্যক্রমকে গোপন রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকা, ইন্টারনেটের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্তি, গণতন্ত্রকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করা। ইসলামী শাসনব্যবস্থা, শরীয়া আইন এবং খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার জন্য অতিমাত্রায় আগ্রহ প্রকাশ করা, ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর প্রকৃত নামে রেজিস্ট্রেশন না করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন পালন, গান বাজনাসহ পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতে নিজেকে গুটিয়ে রাখা এবং শিরক/বিদাত বলে যুক্তি প্রদান করা, হঠাৎ করেই অতিমাত্রায় ধর্মচর্চার প্রতি ঝোঁক, হঠাৎ করে দাড়ি রাখা ও টাখনুর উপর কাপড় পরিধান শুরু করা, মিলাদ, শবে বরাত, শহীদ মিনারে ফুল দেয়াসহ প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিবসসমূহে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা, ধর্মচর্চার পাশাপাশি শরীরচর্চা ও ক্যাম্পিংয়ের মতো বিষয়ে আগ্রহী হওয়া।
এদিকে গণমাধ্যমে এই বিজ্ঞাপন প্রচারের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমলোচনা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞাপনটির সমলোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সাহাব এনাম খান।
তিনি মনে করেন, ‘জঙ্গিবাদ শনাক্তকরণে এ ধরনের সাধারণীকরণ উগ্রপন্থাকে আরও উস্কে দিতে পারে। ধর্মের রাজনৈতিক অর্থনীতি আর ন্যায়বিচার ডিসকোর্সকে বাদ দিলেও এখানে দেয়া ইন্ডিকেটরগুলোর অর্ধেক-ই ধর্মপালনকারীর অধিকাংশ মুসলিমের সামাজিক বাস্তবতা অথবা অন্যায্য সামাজিক রূপান্তরের (শিক্ষা, ইনকাম, অসমতা, রাজনৈতিক মুক্তি, বিনোদন, সংস্কৃতি, বিকল্প প্লাটফরম, গণমাধ্যম ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে) বহিঃপ্রকাশ।’
এই বিশ্লেষক মনে করেন, ‘পাবলিক স্টেটমেন্ট দেয়ার আগে পরিস্থিতির গুরুত্ব ও এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকে বোঝা প্রয়োজন। অন্যথায় এটা উগ্রবাদের প্রক্রিয়াকে আরো বাড়ানোর অপচেষ্টা হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।’