Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

humanএক দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য দেশে প্রবেশ করে মানুষ। সেটি হোক স্থল, নদী কিংবা আকাশপথে। তবে শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রথম নদীতে ঝাঁপ দেয় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষরা। নিজ দেশে নির্যাতন আর নিগ্রহের শিকার রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে নদীর ভয়কে জয় করে আশ্রয়ের জন্য অন্য দেশের সীমান্তে প্রবেশ করা শুরু করে।

এখন জিবিকার তাগিদেও নদী পেরিয়ে অবৈধভাবে অন্য দেশে প্রবেশের পথে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্য দেশের নাগরিকরাও পা ফেলছে। এশিয়ার মধ্যে এই পথে সবার গন্তব্য থাকে মালয়েশিয়া। তবে বাংলাদেশির সংখ্যাও কম নয়।

chardike-ad

বাংলাদেশে নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, সাগরপথে মানব পাচারের ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমবাজারও। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে বৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার পথ সহজ করতে হবে। বিশেষ করে যেসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশি, সেখান থেকে লোক পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কর্মী প্রেরণ ও মানব পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশে জন প্রতি ৬ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত (প্রায় দেড় লাখ টাকা) করে নিয়েছে মানব পাচারকারী চক্র। মালয়েশিয়া প্রবেশের উদ্দেশ্যে এ চক্রের ক্যাম্পে থাকা কেউ অর্থ প্রদান করতে দেরি করলে বা ব্যর্থ হলে, তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতো সিন্ডিকেট সদস্যরা।

মানব পাচার বিষয়ে মালয়েশিয়ার দ্যা রয়েল কমিশন অব ইনকিউরির (আরসিআই) তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দূষিত খাদ্য গ্রহণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং নির্যাতনের কারণে বন্দীদের অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। এসব মৃতদেহ ক্যাম্পের পাশে মাটিতে পুঁতে রাখতো পাচারকারীরা।

গত ২৫ এপ্রিল দেশটির স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পাদাং বিশার ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান তদন্তকারী পরিদর্শক মোহাম্মদ হুসাইয়েরী মুসা বলেছেন, ২০১৫ সালের মে মাসে স্থানীয় ট্যাক্সি চালকসহ ৬ অবৈধ অভিবাসীকে আটকের পর বিষয়টি উদ্ঘাটন করা গেছে। মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার সন্দেহে ট্যাক্সি চালককে আটক দেখানো হয়।

সে সময় আটক হওয়া নূর মোহাম্মদ জানায়, নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে স্ত্রী ও দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে নদী পথে থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। থাইল্যান্ডে পৌঁছাতে ১৫ দিন সময় লেগেছিল তাদের। পরে তাদেরকে ক্যাম্পে তালাবন্দী করে রাখা হয়েছে। ৬ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত পরিশোধের পর তাদের মুক্ত করা হয়।

মোহাম্মদ হুসাইয়েরী মুসা জানান, নূর মোহাম্মদ তাকে বলেছিলেন, থাইল্যান্ডের প্রতিটি ঘাঁটিতে ৩০০ মানুষ ছিল এবং প্রতিটি ক্যাম্পে ৮০ জন করে রাখা হতো। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তিন মাসেরও বেশি সময় ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল এবং অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত মারধর করা হতো।

মানব পাচারের ওপর তদন্তের এমন তথ্য পাওয়ার পর শক্ত অবস্থানে গেছে মালয়েশিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনী। মানব পাচারের বেশ কয়েকটি পথকে চিহ্নিত করে সেখানে বাড়তি নজরদারি রাখছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৬ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এছাড়া আটক স্থানীয় ট্যাক্সি চালককে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ হুসাইয়েরী মুসা।

সমুদ্রপথে মানব পাচারের ভয়াবহতা প্রথম প্রকাশ পায় ২০১৫ সালে। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে মানব পাচারকারীদের কিছু ক্যাম্প ও অভিবাসীদের গণকবর আবিষ্কারের পর, পাচারের শিকার মানুষের চরম মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি সামনে আসে।

এরপর পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সরকারকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হয়। মানব পাচারকারীদের একটি আস্তানা আবিষ্কারের পর সেটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভয়ঙ্কর এই অপরাধের তদন্ত ব্যাহত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কমিশন সুহাকম।

ফলে কিছুটা হলেও নিষ্ক্রিয় ছিল আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়ার পর, তারা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সুহাকমের সঙ্গে ফোর্টিফাই রাইটস নামক আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন যৌথভাবে বিষয়টি তদন্ত করার পর এ অভিযোগ করেছে।

তারা প্রশ্ন তুলেছে- ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশটির ওয়াঙ কেলিয়ান এলাকায় পাচারকারীদের আস্তানা খুঁজে পাওয়ার পরও, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ কী কারণে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গণকবর থেকে মৃতদেহ উদ্ধার ও তদন্ত শুরু করতে বিলম্ব করল?

সুহাকম এবং ফোর্টিফাই রাইটস কয়েক বছর ধরে তদন্ত চালিয়ে ‘মাছের মতো মানুষ বিক্রি’ শিরোনামে ১২১ পাতার একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে ২৭০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে।

humanপ্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াঙ কেলিয়ানে মানব পাচারকারীদের আস্তানা আবিষ্কার হওয়ার পর দিনই কর্তৃপক্ষ তা ধ্বংস করে দিয়েছে। পুলিশ যাতে পরবর্তীতে তদন্ত করে আলামত ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে না পারে, সম্ভবত সে কারণেই সাক্ষ্য মুছে দেয়ার কাজ করা হয়েছে। গণকবর উদ্ঘাটনের চার মাস পর ২০১৫ সালের মে মাসে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ কবর খুঁড়ে লাশ উত্তোলনের জন্য ফরেনসিক দলকে নির্দেশ দেয়। তবে ঠিক কী কারণে দেরি করা হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। এরপর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান।

পাচারের শিকার মানুষদের অনেকেই মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে পাচার হওয়া রোহিঙ্গা। লাশ উত্তোলনে চার মাস দেরি হওয়াও সময়মতো সেগুলোর ময়নাতদন্ত করা যায়নি এবং এর ফলে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করা বাধাগ্রস্ত হয়েছে- জানিয়েছে দুই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, রাসায়নিক পরীক্ষায় ১৫০টি মৃতদেহের মধ্যে শুধু তিনজনের মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করা হয়েছিল। এর ফলে বিচার ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।’

এ প্রতিবেদনের ব্যাপারে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক খালিদ আবু বকর এবং মালয়েশিয়ার পুলিশ কোনো প্রকার মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের গণকবর আবিষ্কারের কয়েক দিন পর থাইল্যান্ড সরকার পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে এবং অবৈধ অভিবাসীদের বহনকারী নৌকাগুলো তাদের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় সাগর উপকূলে ভিড়তে বাধা দেয়।

এরপর মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে সাগরে ভাসমান ৩ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। পাচারকারীরা তাদের নৌকায় করে সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

পুলিশের ব্যাখ্যা: লাশের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন তথ্য দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। তারা বলছে, ১৪৭টি কবর খুঁড়ে ১৩০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।

ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ৩৮ জনকে গ্রেফতার করেছিল, যাদের সবাই অবৈধ অভিবাসী বলে তাদের সন্দেহ। তাদের সঙ্গে মানব পাচারকারীদের কোনো সংশ্রব ছিল না। পরদিনই পাচারকারীদের আস্তানাটি ধ্বংস করে দেয় পুলিশ।

ওয়াঙ বার্মা পাহাড়ে পাচারকারীদের আস্তানা ধ্বংস করার কারণ হিসেবে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার পুলিশ বলেছিল, আস্তানাগুলো ধ্বংস না করলে সেগুলো বিদেশি এবং নাশকতাকারীদের ব্যবহার করার ঝুঁকি ছিল। ধ্বংস করার আগে ক্যাম্পের ছবি রেকর্ড করে বলে জানায় পুলিশ।

মানব পাচার অব্যাহত: থাইল্যান্ডে এ রকম আরও কিছু আস্তানা এবং গণকবর আবিষ্কারের পর সেখানকার সামরিক সরকার মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। পাচারকারী দলের ১০২ জনকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। আদালতে ৬২ জন দোষী সাব্যস্ত হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সেনাবাহিনীর তিন তারকা বিশিষ্ট জেনারেল।

অভিযান এবং বিচারকার্যের পরও নিরীহ বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকদের পাচারকারী চক্রের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। পাচারের শিকার বেঁচে যাওয়া হতভাগ্যদের সুরক্ষা ব্যবস্থাও নিতান্তই সীমিত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ফোর্টিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথ্যু স্মিথ বলেছেন, মানব পাচার এখনো চলতে দেয়া হচ্ছে। কারণ পাচারকারীদের অনেক ক্ষেত্রেই অর্থবহ বিচারিক পরিণতি বরণ করতে হয় না।

তিনি বলেন, যত দিন বিচারহীনতা থাকবে, তত দিন মানব পাচার থাকবে। মিয়ানমারে গণহত্যার প্রসঙ্গেও বিষয়টি একই রকম, যে কারণে শরণার্থী সঙ্কট অব্যাহত আছে।

মানব পাচার আস্তানার খবর প্রচার হওয়ার পর মালয়েশিয়ায় ১২ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু বিদেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে পুলিশ সদস্যদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।

২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি বলেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। মালয়েশিয়ার কারও বিচারে সাজা হয়নি। দুজন মিয়ানমারের নাগরিক, একজন বাংলাদেশি এবং একজন থাইল্যান্ডের নাগরিকসহ মোট চার বিদেশির মানব পাচারের অভিযোগে সাজা হয়।

সৌজন্যে- জাগো নিউজ