বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কেন্দ্রীয় ভাণ্ডার বিভাগের ভাণ্ডার অধীক্ষক হামির মিয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি’র এক তদন্ত প্রতিবেদনে অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা সত্ত্বেও হামির মিয়াকে দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। ফলে এই কর্মকর্তা আরও লাগামহীন হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া হামির মিয়া নিজেকে সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই পরিচয় দিতেন বলেও জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১১ সালে বিআইডব্লিউটিসিতে স্টোর অফিসার হিসেবে যোগ দেন হামির মিয়া। পরে ভাণ্ডার অধীক্ষক পদটি শূন্য হলে অতিরিক্ত দায়িত্ব পান তিনি। ওই দায়িত্ব থাকাকালে সংস্থার সবকিছু ক্রয়ে ৩-৫ শতাংশ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কমিশন আদায় করতেন তিনি। কমিশন না দিলে ঠিকাদারের বিলে স্বাক্ষর করতেন না। এছাড়া টাকার বিনিময়ে নিম্নমানের মালামাল নেওয়া, টেকনিক্যাল লোক না হওয়া সত্ত্বেও মালামাল যাচাই কমিটিতে থাকা, সংস্থার অন্যান্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ তুলে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্ত করানোর কথা বলে ঘুষ আদায় করা এবং নিয়মিত অফিস না করার মতো অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বিআইডব্লিউটিসির ড্রাইডক প্রধান তৈয়েবুর রহমানের বিরুদ্ধে সংস্থার প্রপেলার ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে বেনামি একটি অভিযোগ জমা পড়ে। ওই অভিযোগপত্রে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ উল্লেখ করা হয়। অভিযোগটি তদন্ত করার দায়িত্ব পড়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিকরুর রেজা খানমের ওপর। তিনি তদন্ত করে ২০১৬ সালের ১১ মে প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত করতে গিয়ে তিনি দেখেন অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। তার তদন্তে স্টোর অফিসার হামির মিয়ার অনিয়মের চিত্র উঠে আসে এবং বেনামি অভিযোগটি তিনিই করেছেন বলে প্রমাণিত হয়।
ওই অভিযোগটি তদন্তকালে সংস্থার তালিকাভুক্ত মেসার্স খলকু ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের ডিরেক্টর বদরুল আলম তদন্ত কর্মকর্তা জিকরুর রেজা খানমকে জানান, হামির মিয়ার বিরুদ্ধে কথা বললে সন্ত্রাসী বাহিনী লাগিয়ে দিয়ে তাকে মেরে ফেলবে।
একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, ‘বিআইডব্লিউটিসির সব কাজের ক্ষেত্রে বিল পাসের আগেই হামির মিয়াকে ৩ শতাংশ কমিশন দিয়ে দিতে হয়। প্রপেলার সরবরাহ করার সময় তাকে তিন লাখ টাকা আগেই দিয়ে দিতে হয়েছে। প্রপেলার ভেঙে যাওয়ার পর হামির মিয়া তার সঙ্গে ৫ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট করতে বলেন। না হয় তাকে দেখে নেওয়া ও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্ত করানোর হুমকি দেন।’
তদন্তে ডকইয়ার্ডের নথিপত্র ও রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণে দুর্বলতা দেখা গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা হামির মিয়ার উপস্থিতি দেখতে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি অ্যাটেনডেন্ট রেজিস্টার খাতা নিজের কাছেই রেখেছেন। এতে তদন্ত কর্মকর্তার সন্দেহ হলে তিনি গোপনে অনুসন্ধান করেন। তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হামির মিয়া ঠিকমতো অফিস করেন না। তিনি নিজেকে মন্ত্রীর ভাইয়ের পরিচয়ে অফিসে ও এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। ওই অফিসের সবাই তার বিষয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। কেউ তার বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। তদন্তে আরও দেখা গেছে, তিনি শেয়ারবাজারে ৫ লাখ টাকা লস করেন। এরপর অফিসে চাঁদাবাজি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেন।
প্রতিবেদনে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এগুলো হচ্ছে- হামির মিয়ার মতো একজন দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীকে স্টোর অফিসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে যে কোনও সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তার মতো নন টেকনিক্যাল লোককে যাচাই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা সরকারি বিধি-বিধানের পরিপন্থি। মন্ত্রীর ভাই পরিচয়ে যেসব চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কাজকর্ম করেছেন তাতে মন্ত্রীর ভাবমূর্তি চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। অফিসের আইন-কানুন সম্পর্কে কোনও প্রাথমিক জ্ঞানও নেই তার।
হামির মিয়ার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠার পরও তার বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দেড় মাসের ২০১৬ সালের ২২ জুন তাকে ভাণ্ডার অধীক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা জিকরুর রেজা খানম (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, ‘আমি এখন অবসরে। ওই সময় আমি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছি। তখন ওই কর্মচারী আমাকে বলেছিলেন, ম্যাডাম তদন্ত তো করছেন আমার কিছুই করতে পারবেন না। সে তো নিজেকে শাজাহান খানের ভাই পরিচয় দেয়। এখন তার বিষয়ে কী হয়েছে না হয়েছে আর বলতে পারছি না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ঠিকাদার ও কর্মকর্তারা জানান, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই পরিচয় দিয়ে হামির মিয়া অফিসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ঠিকাদারদের প্রতিটি কাজে কমিশন ছাড়া বিলে সই করেন না। তার কারণে অনেক ঠিকাদার এরই মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে দিয়েছেন। কমিশন না দেওয়ায় নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে কয়েকজন ঠিকাদারের ওপর হামলাও করেছেন। তার বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি তদন্ত চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী আব্দুর রহিম তালুকদার বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছেন। তিনিসহ আমাদের চেয়াম্যানও তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করতে বলেছেন। এক কর্মকর্তা আশ্বাস দেওয়ার পর এখনও তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘তার (হামির মিয়া) বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। ঠিকাদাররা মালামাল সরবরাহ করলে তিনি নিজে ভেঙে দিয়ে বলেন, মালামাল ভাঙা। পরে তাদের থেকে টাকা দাবি করেন। কমিশন ছাড়া বিলে সই করেন না। অল্প কয়েক বছরের চাকরি করে ৫তলা বাড়ি, গাড়ি করেছেন। তিনি সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এসব অনিয়ম করে আসছেন। মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ থাকায় তার বিরুদ্ধে আমরা কোনও ব্যবস্থা নিতে পারিনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হামির মিয়া বলেন, ‘অভিযোগ উঠলে সমস্যা কী? এতে আপনার এত ইন্টারেস্ট কেন? পৃথিবীর সব সাংবাদিক লিখলেও আমার কিচ্ছু আসে যায় না। কারণ আমি অনিয়ম ও দুর্নীতি করি না। এসব অভিযোগ সঠিক নয়।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘যে প্রতিবেদনটির কথা বলা হচ্ছে সেটি ভুয়া। বিআইডব্লিউটিসির বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী নিজেই দুর্নীতি করতে পারছেন না বলেই আমার নামে এসব করেছেন। আমি সেখান থেকে অনেক আগ থেকেই বদলি হতে চাই। বদলির জন্য টাকাও দেবো বলছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাকে বদলি করে না। করপোরেশনকে রক্ষা করার জন্যই আমাকে সেখানে রাখা হয়েছে।’
হামির মিয়ার দাবির বিষয়ে জানতে শাজাহান খান বলেন, ‘আমার কোনও ভাই বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি করে না। যদি কেউ এমন বলে থাকে তাহলে তা মিথ্যা।’
সৌজন্যে- বাংলা ট্রিবিউন