সুইডেনে প্রায় ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বসবাস করে থাকেন। সুইডেনের আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে- এটি মোবাইল কমিউনিকেশনের জন্মস্থান। দক্ষতা আর শিক্ষাগত যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে তারা বিভিন্ন ধরনের কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ আছেন পড়াশোনার জন্য। তবে এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের আতিথেয়তায় বল্টিক সাগর পাড়ের দেশটিতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, ইউরোপের অন্য দেশের থেকে অনেক ঘটনাবহুল ছিল। সেখানকার জনপ্রিয় বাংলাদেশি খাবারের গল্প শোনাচ্ছেন মোহাম্মদ মাহাভি-
সুইডেনে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল নোবেল পুরস্কার কমিটির আয়োজনে তিন দিনের একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা। শেষ দিনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, যা ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা। ইউরোপে এরআগে ভ্রমণ করলেও সুইডেন ছিল আমার জন্য প্রথম। বিমান থেকে নেমেই স্টকহোমের আরলান্ডা বিমানবন্দরে ছোটভাই-বন্ধু সজীব আমাকে বোকা বানালো পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ও বলেছিল, জরুরি কাজের জন্য আসতে পারবে না। প্রায় ১৭ মাস পর দেখা হলো সজীবের সাথে। আনন্দ, উত্তেজনা, আবেগ মিলিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি ছিল। সজীব ও তার স্ত্রী দিবা পেশায় চিকিৎসক। এখানে স্নাতকোত্তর পড়তে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে।
আমি আর সজীব বিমানবন্দর থেকে চলে যাই নোবেল পুরস্কার কমিটির ঠিক করা স্টকহোমের ইতিহাস সমৃদ্ধ ওল্ড টাউন গামলাস্টানের একটি জাহাজে। জাহাজগুলো হোটেল হিসেবে নোঙর করে রাখা হয়েছে কিছুদিনের জন্য। সেখানেই কেটে যায় প্রথম তিন দিন। এরপর সেখান থেকে সম্মেলন শেষ করে তিন দিন পর সজীবের বাসার দিকে রওনা দিলাম। আমি থাকবো বলে দিবা স্টকহোমে তার বাসা ছেড়ে পাশের শহর ওরেব্রোতে (যেখানে ওর ইউনিভার্সিটি) ওদের আরেকটি বাসায় গিয়ে উঠেছে। স্টকহোমে সজীবের বাসা হলো ভাক্সহোমে। এই ভাক্সহোম মূলত ছোট ছোট দ্বীপের মত। কখনো সেতু, কখনো ফেরি দিয়ে এ ছোট দ্বীপগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।
ভাক্সহোম যাওয়ার আগে সজীব নিয়ে গেল শিস্থায়। শিস্থাকে ইউরোপের ‘সিলিকন ভ্যালি’ বলা হয়ে থাকে। কারণ মোবাইল কমিউনিকেশনের বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়ে থাকে শিস্থাতেই। বিশ্ব বিখ্যাত মোবাইল ফোন এরিকসনের হেড অফিস এখানে। মোবাইল ফোন তৈরি বন্ধ করে দিলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় এক লাখের বেশি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন এখানে। সেখানেই শিস্থা গার্ডেন (Kista Garden) নামে একটি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করেন রেজাউল হক রেজা ভাই। রেজা ভাই সজীবের অনেক প্রিয় মানুষ হলেও তার কথা আমি আগেও শুনেছি আরেক চিকিৎসক দম্পতি আনোয়ার ও সাদিয়ার কাছ থেকে।
শিস্থা গার্ডেন রেস্টুরেন্টে গিয়ে প্রথমে যে জিনিসটি চোখে পড়ার মত ছিল, তা হলো ভেতরের সবকিছুই সাজানো হয়েছে বাংলাদেশি সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে। বিদেশ ভ্রমণে আমার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে একটি অম্লমধুর অভিজ্ঞতা হলো, অনেকে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট পরিচালনাকারী নিজেদের ‘ভারতীয় রেস্টুরেন্ট’ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অবশ্য এর পেছনেও আছে বিশেষ কারণ। ইউরোপিয়ান রেস্টুরেন্ট বিধিতে ভারতীয়, আরবীয় বা ইতালিয়ান খাবার বিক্রির উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশি খাবার আলাদাভাবে পরিচিতি পায়নি। সেই সঙ্গে উপমহাদেশ থেকে ভারতীয় ক্রেতার পরিমাণও বেশি, যা ব্যবসার জন্য লাভজনক। সবদিক বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট হয়ে ওঠে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় একটি বড় রেস্টুরেন্ট দেখেছিলাম, যারা উপমহাদেশীয় খাবার পরিবেশন করে, নাম বোম্বাই ক্যাফে। কিন্তু বোম্বাই ক্যাফের মালিক মূলত বাংলাদেশের আমজাদ ভাই।
সবদিক মাথায় রেখে শিস্থা গার্ডেনের সাইন বোর্ডে লেখা আছে ভারতীয় আর বাংলাদেশি খাবার পরিবেশনকারী রেস্টুরেন্ট হিসেবে। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতেই কানে ভেসে এলো আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ গানটি। আরেকটি বিশেষ দিক হলো, পশ্চিমা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এই রেস্টুরেন্টে নেই কোন অ্যালকোহল বিক্রির স্থান। তারপরও এটি সার্বিকভাবে খাবারের বিক্রির ওপর কোন প্রভাব ফেলেনি। এখানে মানুষ আসে শুধু খাবারের কথা চিন্তা করেই। এই রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে অবাক করা দিক হলো, রন্ধনশালা থেকে শুরু করে পরিবেশনকারী সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। রেজা ভাই বাদে সেখানে কাজ করেন এমন মানুষের মধ্যে আমার পরিচয় হয়েছিল হাফিজুল, হাবিবুর, নাজমুল, সাইদ, রাব্বির সঙ্গে। তারা সবাই অনেক আন্তরিক ছিল পুরোটা সময়।
একদিনে সব খাওয়া সম্ভব না, তাই প্রথম দিন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বিরিয়ানি চেখে দেখবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। রেজা ভাই আমাদের দু’জনের জন্য দুই ধরনের বিরিয়ানি দিলেন। একটি একদম আসল দম বিরিয়ানি, আরেকটি একটু বিশেষ কায়দায় বানানো ল্যাম্ব বিরিয়ানি। টানা চার দিন ওয়েস্টার্ন ধাঁচে খেয়ে, বিরিয়ানি প্রথম মুখে দিতেই যেন চোখে পানি চলে আসার মত অবস্থা। কিন্তু সত্যি বলতে, অনেক দিন পর এত ভালো বিরিয়ানি খাচ্ছি বলে মনে হলো। এরপর গোগ্রাসে পুরোটা শেষ করে ফেললাম। স্কান্ডেনেভিয়ার দেশগুলোর রেস্টুরেন্টে টাটকা ও সুস্বাদু সালাদ দেওয়া হয় একদম ফ্রি। এক প্লেট পরিমাণ সালাদের উপকরণ দেশের বড় কোন শপিং মল থেকে কিনতে গেলে হাজারখানেক টাকা এক নিমিষেই বের হয়ে যাবে।
মানুষ খায় পেট ভরে। কিন্তু উপমিত করতে গেলে বলা যায়, আমাদের ওইদিন খাওয়া হয়েছে গলা পর্যন্ত। এরপর এলো সেই অপ্রীতিকর মুহূর্ত। রেজা ভাই বিল নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। অতিথিপরায়ণ মানুষটি নিমন্ত্রণবিহীন এ খাওয়া-দাওয়াকে অসম্পূর্ণ বললেন। সেইসঙ্গে আরেকদিন খাবার দাওয়াত দিয়ে দিলেন। কিন্তু তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালাম, পরের বার খাবাবের মূল্য পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার।
স্টকহোম ঘুরে দেখার ফাঁকে শুক্রবার দুপুরে আবার গেলাম শিস্থা গার্ডেনের অন্য জনপ্রিয় খাবার চেখে দেখতে। এবার দেখি অন্যরকম অবস্থা। একটুকু বসার জায়গা নেই কোথাও। বিদেশি মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে খাবার নেওয়ার আশায়। আমাদের দেখে রেজা ভাই অনুরোধ করলেন একটু পরে বসার। বললেন, এই ফাঁকে মল অব স্কান্ডেনেভিয়া ঘুরে আসতে। মল অব স্কান্ডেনেভিয়া বেশ বড় শপিং মল। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানকার ব্র্যান্ডগুলোর পছন্দের জিনিসের দাম সাধ্যের বাইরে মনে হলো। যা হোক, একটু ঘুরে-ফিরে সজীবকে সঙ্গে নিয়ে আবার এলাম চারটার দিকে। কিন্তু তখনো অল্পস্বল্প ভিড় আছেই। প্রচুর হাঁটতে হয়েছিল বলে ভালোই ক্ষুধা লেগেছিল। তাই হালকা সালাদ খেয়ে নিলাম এই ফাঁকে। খেতে খেতে একজন বৃটিশ ভদ্রলোকের সাথে কথা হলো, যিনি একটি আইটি কোম্পানিতে কাজ করছেন। তিনি উপমহাদেশীয় খাবারের ভক্ত ইংল্যান্ডে টমি মিয়ার কারি আইটেম খেয়ে। শিস্থা গার্ডেনে তার নিয়মিত আসা-যাওয়া হয় শুধু উপমহাদেশীয় খাবারের প্রতি তার আসক্তির কারণে। শিস্থা গার্ডেনের মেন্যু দেখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন তাদের www.kistagarden.se ওয়েবপেজ থেকে।
রেস্টুরেন্টের ভিড় কমলে রেজা ভাই বললেন, তাদের আরও কিছু জনপ্রিয় সিজলিং বিফ, চিকেন, ফিস আইটেম চেখে দেখার জন্য। সেই সাথে সাদা পোলাও আর বাটার চিকেনের জন্য বলে দিলেন কিচেনে। অনুমতি নিয়ে আমিও চলে গেলাম তাদের কিচেনে। আর তুলে ফেললাম খাবার তৈরির কিছু ছবি। দেখতে প্রায় একই রকম হলেও এসব খাবার ছিল অন্যরকম। কারণ হিসেবে হাফিজুল, হাবিবুর এবং নাজমুল জানালেন মজার তথ্য। প্রথমত, খাবারে স্বাদ পরিবর্তন শুরুই হয় পানি থেকে। এখানে খাবার পানি আসে সাপ্লাইয়ের পাইপে। এই পানিতে খনিজের পরিমাণ থাকে একদম মাপা। যা খাবারে রান্নার সময় ও স্বাদের উপর প্রভাব ফেলে। সেইসঙ্গে খাবারের কাচামাল ও মসলা উপকরণে ভেজালের সম্ভাবনা একদমই শূন্য। এতে দেশের থেকে মসলা এনেও এখানে দেশের স্বাদের খাবার তৈরি করা মুশকিল হয়ে যায়।
পড়ন্ত বিকেল থেকে আড্ডা দিতে দিতে প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। কিন্তু কথা তো ফুরায় না। আমি দেশে ফিরে যাবো পরদিনের ফ্লাইটে। তাই আমার ভালো লাগাগুলোও শেয়ার করছিলাম। শেষমেশ না চাইতেও আড্ডা শেষ করে যাওয়ার সময় রেজা ভাই আবার আমদের সেই আগের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিলেন। এবারও তিনি টাকা নিবেন না। কিন্তু টাকা না নিলে তো ওয়াদা ভঙ্গ করা হবে। আমাদের কথা রাখতে তিনি টোকেন হিসেবে এক সুইডিশ ক্রোনার রাখলেন, যেটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।
এসব মধুর স্মৃতি নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে শিস্থা গার্ডেন থেকে বের হলাম মেট্রো স্টেশনের পথে। মাত্র কয়েক দিনের আতিথেয়তায় পাল্টে গেল আমার দৃষ্টিভঙ্গি। রেজা, হাফিজুল, হাবিবুর, নাজমুল, সাইদ, রাব্বি ভাইদের মত মানুষকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না। তাদের পরিশ্রম দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও বেশি গতিশীল করেছে সময়ের সাথে। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে তাদের কঠোর পরিশ্রম আমাদের ভালো রাখতে অবদান রাখছে। সেইসঙ্গে সেখানে তাদের আতিথেয়তার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করা যাবে না। সেখানে ভালো থাকুক বাংলাদেশিরা, তাহলে ভালো থাকবে বাংলাদেশ।
লেখক- মোহাম্মদ মাহাভি, ভ্রমণ সহযোগিতায়- ডা. সিকান্দার হায়াত খান সজীব