Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

biman-bangladeshনির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক কম ফ্লাই করেও প্রতিমাসে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অপারেশন্স পরিচালকসহ পাঁচ পাইলট। শুধু তা-ই নয়, বেতনের বাইরে শুক্র-শনিবার ফ্লাই করার নামে মাসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে ‘ডে-অফ ফি’ও উঠাচ্ছেন অনেকে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ অন্য পাইলটরা।

তাদের অভিযোগ, একদিকে কেউ অতিরিক্ত ফ্লাই করছেন আবার কেউ ফ্লাই না করে বসে বসে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অবিলম্বে এ বৈষম্য বন্ধ করার দাবি জানান তারা।

chardike-ad

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানের আইন অনুযায়ী, বছরে একজন পাইলটকে কমপক্ষে ৭৫০ ঘণ্টা ফ্লাই করতে হবে। এর নিচে ফ্লাই করার অর্থ বসে বসে বেতন নেয়া। যদিও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একজন পাইলটের বছরে ১ হাজার ঘণ্টা ফ্লাই করা নিরাপদ।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ বিমানের ১৪ জন পাইলট ৮০০ ঘণ্টার নিচে ফ্লাই করেছেন। এর মধ্যে ৭০০ ঘণ্টার নিচে ফ্লাই করেছেন ৫ জন। ৭০০ ঘণ্টার ওপরে কিন্তু ৮০০ ঘণ্টার নিচে ফ্লাই করেছেন ৯ জন। ফলে বাধ্য হয়ে বিমানের বাকি ১৮ পাইলটকে ৮৫০ ঘণ্টা থেকে থেকে শুরু ১ হাজার ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্লাই করতে হয়েছে।

আগে বিমানে পাইলটদের বেতন হতো ফ্লাইং আওয়ার অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টা অনুযায়ী। কিন্তু পাইলটরা আন্দোলন করে ২০০৮ সাল থেকে তাদের বেতন স্থায়ী করে নেন। অর্থাৎ ফ্লাই করুক আর না করুক, বিমানকে প্রত্যেক পাইলটের জন্য মাসিক বেতন দিতে হতো গড়ে ৭ লাখ টাকা।

সম্প্রতি আবারও পাইলটদের বেতন ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এখন একজন সিনিয়র পাইলট মাসে বেতন পাচ্ছেন ৯ লাখ টাকা। এর বাইরে মাসে ৭৫০ ঘণ্টার বেশি ফ্লাই করলে প্রতি ঘণ্টার জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা অ্যালাউন্স দিতে হচ্ছে।

এছাড়া মাসে ৮ দিন বাধ্যতামূলক ছুটি পান একজন পাইলট। কোনো কারণে ওই ছুটি কর্তন করা হলে প্রতিদিনের জন্য ১৪ হাজার টাকা ‘ডে অফ ফি’ দিতে হয়।

ক্ষুব্ধ পাইলটরা জানান, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এমনিতেই তারা কম ফ্লাই করছেন। এতে বিমানের অনেক টাকা লোকসান হচ্ছে। তার ওপর অনেকে ফ্লাই না করেই বেতন নিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে যে কোনো প্রতিষ্ঠানই দেউলিয়া হয়ে পড়বে। আর কোনো পাইলট যদি ক্ষোভ নিয়ে ফ্লাই করেন, তাহলে ওই ফ্লাইট বড় ধরনের ঝুঁকিতে থাকবে। অভিযোগ আছে, বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন্স (ডিএফও) ক্যাপ্টেন জামিল আহমেদ ২০১৮ সালে ফ্লাই করেছেন মাত্র ২৪২ ঘণ্টা।

অথচ তিনি প্রতি মাসে গড়ে ৯ লাখ টাকার (ট্যাক্স ছাড়া) পাশাপাশি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ‘ডে অফ ফি’ উঠাচ্ছেন। এই ২৪২ ঘণ্টার মধ্যে অধিকাংশই ছিল ভিআইপি বা ভিভিআইপি ফ্লাই। অথচ ক্যাপ্টেন জামিল বিমানের একজন উচ্চপর্যায়ের সিমুলেটর ইন্সট্রাক্টর। অথচ তিনি সিমুলেটর ট্রেনিংয়েও ফ্লাই করেন না।

ফলে বিদেশি ইন্সট্রাক্টর নিয়োগ দিতে তার ফ্লাইগুলো করাতে হচ্ছে। এছাড়া ক্যাপ্টেন জামিলের ফ্লাইগুলো করানোর জন্য প্রতিমাসে অন্য একজন পাইলটকে ৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে।

এছাড়া বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুব ২০১৮ সালে ফ্লাই করেছেন মাত্র ৫৯৬ ঘণ্টা। তিনিও প্রতি মাসে গড়ে ৯ লাখ টাকা করে বেতন-ভাতা উঠাচ্ছেন। তার ফ্লাইগুলো করানোর জন্যও প্রতিমাসে গড়ে ৫ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে বিমানকে। একইভাবে ক্যাপ্টেন মাহাতাব আহমেদ ২০১৮ সালে ফ্লাই করেছেন ৬২২ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন রেজোয়ান আহমেদ করেছেন ৬৭৭ ঘণ্টা এবং ক্যাপ্টেন নোমান করেছেন ৬৮১ ঘণ্টা।

অপরদিকে ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক হোসেন ২০১৮ সালে ফ্লাই করেছেন ৭১৯ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন মানজুর ৭৩৩ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন ইসমাইল ৭৪৬ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন আলী ৭৫৮ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন সাজিদ ৭৬১ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন ইমদাদ ৭৬২ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন পারভেজ ৭৬৪ ঘণ্টা, ক্যাপ্টেন খাজা ৭৮৬ ঘণ্টা এবং ক্যাপ্টেন এস হোসেন ৭৮৬ ঘণ্টা। ৮০০ ঘণ্টার বেশি যেসব ক্যাপ্টেন ফ্লাই করেছেন তাদের মধ্যে আরিফ ৮২৪, শাহরিয়ার ৮৩৪, মাসউদ ৮৫৯, মনির ৮৭০, এমদাদ ৮৭৩, অরবিন্দ ৮৭৭, বজলু ৮৮৪, ইলিয়াস ৮৫৫, মেহেদী ৮৯০, ইশহাক ৯২২, ইসমাইল ৯২৪, জাকির ৯৩৭, ইশতিয়াক ৯৪৮, হাসনাইন ৯৫৮, ইমরাত ৯৬০, এইচ ইমাম ৯৭৮ ও তোফায়েল ৯৯১ ঘণ্টা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার কারণে বিমানের প্রতিটি শাখায় এভাবে অনিয়ম হচ্ছে। এসবের অবসান না হলে একের পর এক উড়োজাহাজ যোগ করেও বিমানকে সংকটমুক্ত করা যাবে না।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিমানের লোকসান ছিল প্রায় ২০১ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছর ২০১৭ সালে লোকসান ছিল ২১৪ কোটি টাকা এবং এর আগের বছর ছিল প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। তাছাড়া সিডিউল বিপর্যয়, রুট ও টিকিট সংকটসহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগে অনেক যাত্রীই এখন আর বিমানে ভ্রমণে উৎসাহী নন।

পাইলটদের ফ্লাই নিয়ে অনিয়ম প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মুহিবুল হক বলেন, পাইলটদের বেতন-ভাতা অনেক বাড়ানো হয়েছে। তারপরও যদি কোনো পাইলট সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি বলেন, পাইলটদের ডিউটি রোস্টার নিয়ে শিগগিরই বিমান এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহম্মেদকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হবে। এরই মধ্যে পাইলট নিয়োগে গুরুতর অনিয়মের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে এবং কারা দায়ী, তা চিহ্নিত করতে ১ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট দেয়ার জন্য কমিটিকে সাত কার্যদিবস সময় দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে এ বিষয়টি দেখভালের জন্য আরও একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে দেয়া হবে। কারণ এমনিতে বিমানকে লোকসান দিতে হচ্ছে। তারপরও যদি ফ্লাইং আওয়ার নিয়ে পাইলটদের মধ্যে রাগ-বিরাগ কিংবা ক্ষোভ থাকে, তাহলে ফ্লাইট ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তাছাড়া কেউ বসে বসে বেতন নেবে আর কেউ ডিউটি করবে, এটা চলতে দেয়া যাবে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে বিমানের ডিএফও ক্যাপ্টেন জামিল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অন্য পাইলটদের সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। যেহেতু আমি ম্যানেজমেন্টে আছি, সেজন্য আমার ছাড় আছে। পলিসিগত কারণে আমি ডিউটি করতে পারছি না। অর্থাৎ ম্যানেজমেন্টের কাজ সামলাতে গিয়ে তিনি ফ্লাইট করতে পারছেন না বলে জানান।

বিমানের সাবেক এক পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমানের প্রত্যেক ডিএফও বছরে কমপক্ষে ৭০০ ঘণ্টার ওপরে ডিউটি করেছেন। কারণ বিমানের ডিএফও’র কাজ খুবই সামান্য। তিনি বলেন, বর্তমান ডিএফও একজন সিমুলেটর ও এয়ারক্রাফট ইন্সট্রাক্টর। তাকে অবশ্যই ফ্লাই করতে হবে।

সৌজন্যে- যুগান্তর