Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

jahidনিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চে যখন হামলা হয়, তখন মসজিদের ভেতরেই ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক ওমর জাহিদ। মসজিদে খুতবা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরেই তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। তার পিঠে এখনো রয়েছে গুলির একটি ক্ষত।

গত ১৫ মার্চের ওই হামলার ঘটনায় অন্তত ৫০জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেক মানুষ। হামলাকারী পুরো হামলার ঘটনাটি নিজেই ভিডিও করে লাইভ সম্প্রচার করে। তাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

chardike-ad

বিবিসি বাংলার কাছে সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে দিয়ে তিনি বলছিলেন, নিউজিল্যান্ড অবশ্যই ভালো একটি দেশ, এটা আমরা বিশ্বাস করতাম এবং এখনো করি। এতদিন ধরে আমরা খুব ভালো একটি জীবনযাপন করছিলাম।

”সেদিন ছিল শুক্রবার। মুসলমান হিসাবে প্রতি শুক্রবারেই জুমার নামাজ পড়তে আমরা মসজিদে যাই। দুপুর সাড়ে ১২টায় আমার কাজ শেষ করে নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নে।” বলেন মি. জাহিদ। ”ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজ শুরু হয় দুপুর ২টায়। খুতবা শুরু হয় তার আধঘণ্টা আগে, দুপুর দেড়টায়।”

ওমর জাহিদ বলছেন, ”ওই দিন আমি একটু আগে গিয়েছি, যাতে খুতবা শুনতে পারি। এজন্য বাসা থেকে বের হয় পৌনে একটা বা ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে। আমার নিজের গাড়ি চালিয়ে মসজিদে পৌঁছাই ১টা ১০ মিনিটের দিকে।

”এরপর মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ি। এরপর দ্বিতীয় সারিতে গিয়ে বসি, ঠিক মুয়াজ্জিনের পেছনে। দেড়টার দিকে ইমাম সাহেব প্রবেশ করে তার স্থানে গিয়ে সালাম দিয়ে সবে দুই একটা কথা বলতে শুরু করেছেন।”

”এমন সময় আমরা বাইরে থেকে বিকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম আতশবাজি বা বৈদ্যুতিক কোন শর্টসার্কিট হয়েছে। একটু পরেই দেখতে পাই পেছনের মানুষজন দৌড়াদৌড়ি করছে, চিৎকার করছে। তখন আমাদেরও মনে হলো যে খারাপ কিছু হয়তো ঘটছে। কিন্তু গোলাগুলি হচ্ছে কিনা, সেটা তখনো আমি ঠিকভাবে বুঝতে পারিনি।”

ওমর জাহিদ বলছেন, ”তখন আমি ডানপাশে গিয়ে একেবারে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার সাথে অন্য যারা ছিলেন, তারাও শুয়ে পড়লেন, তবে কয়েকজন হয়তো বের হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ হয়তো বেঁচে গেছেন। তবে সেই দিন অনেকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।”

তিনি বলছেন, ”আমি আসলে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। কারণ আমার ডানপাশে যিনি ছিলেন, তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তিনি মারা গেছেন কিনা জানি না। আমার পায়ের কাছে ছিল একটি সোমালিয়ান বাচ্চা, সে মারা গেছে। বাম পাশেও একজন ছিলেন, তিনিও মারা গেছেন কিনা নিশ্চিত নই।”

”যখন গুলি করা হচ্ছিল, তখন আমার বাম কাঁধে একটি গুলি লাগে। তখন আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি হয়তো মারা যাচ্ছি বা মারা যাবো।”

”প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের মতো গুলি করা হয়েছে, সঠিক সময়টা আমার মনে নেই। পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ।”

”আমি জানি না কিভাবে আমি বেঁচে ফিরে এলাম। কারণ ভিডিওতে পরে আমি দেখেছি, আমার দিকে সে তিন চারবার গুলি করেছে। আসলে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি।”

তিনি বলছেন, ”যখন গুলি থেমেছে, তখন আমি দুইজন ভারতীয় বন্ধুকে দেখতে পেলাম। তাদের সঙ্গে আগের বাসায় একসঙ্গে থাকতাম। আসিফ নামের ওই বন্ধুকে আমি ডাকলে তিনি এসে আমাকে পরীক্ষা করে বললেন যে, বুলেট আমার শরীরের ভেতরে যায়নি, শুধুমাত্র একটু স্পর্শ করে গেছে, একটু জখম হয়েছে।” ”তখন আমি উঠে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, বন্দুকধারী কি চলে গেছে? ওরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারল না।”

”আমি উঠে পাশের যে মুরুব্বি শুয়ে ছিলেন, তাকে জাগানোর চেষ্টা করলাম। তাকে আমি চিনি, কিন্তু নাম জানি না। তবে তিনি কোন সাড়া দিচ্ছিলেন না। আমি ভাবলাম তিনি হয়তো মারা গেছেন। এরপরে আমি যখন পেছনে তাকালাম, যা দেখলাম তা দেখে আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।”

”তিন থেকে চার বছরের যে ছেলেটাকে একটু আগেই কোরান শরীফ পড়ে রাখতে দেখেছি, সে হয়তো একজন হাফেজ, তাকে দেখি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, মুখে গুলির আঘাতের চিহ্ন। ”

”গুলি শুরু হওয়ার আগে মোজাম্মেল হক নামের যে বন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যাপারে গল্প করছিলাম, তাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোথাও দেখতে পেলাম না। যখন আশেপাশে তাকালাম, দেখলাম যে আমার পরিচিত অনেকেই পড়ে আছেন।”

ওমর জাহিদ জানাচ্ছেন, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মুসলমান সম্প্রদায়টি অনেক ছোট। সবমিলিয়ে তিন শ’ জনের মতো ব্যক্তি নিয়মিত মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে আসেন। এ কারণে প্রায় সবাই একে অপরকে চেনেন।

তিনি বলছেন, ”দেখতে পেলাম একজন ভারতীয় ব্যক্তি, যিনি এখানে আসার আগে কিউবায় থাকতেন, এক কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে সোফার মধ্যে বসে আছেন। তিনি খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন, একটি ডেইরি দোকানের মালিক ছিলেন।”

এরপর পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ডের মতো মসজিদে ছিলেন ওমর জাহিদ। পেছনের এলাকা অর্থাৎ পার্কিং এলাকা থেকে দেয়াল টপকে একটি বাসায় আশ্রয় নেন।

ওই বাসায় একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি হয়তো সামরিক বাহিনী বা পুলিশের ডাক্তার ছিলেন। তিনি প্রাথমিক পর্যায়ের সহায়তা দিলেন। আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন ছিলেন, যাদের অবস্থা ছিল আরো গুরুতর।

একটু পরে অ্যাম্বুলেন্স এসে গুরুতর আহতদের জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ তাদের বলে যে, তারা যেন এখান থেকে অন্য কোথাও না যান, কারণ তখনো হামলাকারীকে আটক সম্ভব হয়নি।

বিকাল সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশের গাড়ি এসে ওই বাসা থেকে তাকে নিয়ে নিজের বাসায় পৌঁছে দেয়। এরপর জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করা হলে কর্মীরা এসে ইসিজি, ব্লাড টেস্ট আর ড্রেসিং করে দেয়।

ওমর জাহিদ বলছেন, ”এরপরে আমি আবার হাসপাতালে গেলাম আমার বন্ধুদের খবর নিতে। কিন্তু এখনো তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি।”

সূত্র: বিবিসি