কত স্বপ্ন নিয়ে দেশ, পরিবার, সমাজ ছেড়ে পাড়ি দিতে হয় বিদেশে। মা-বাবা, ভাই-বোনের আদর-স্নেহ, মায়া মমতা, ভালোবাসা উৎস্বর্গ করে উন্নত জীবনের স্বপ্নে হৃদয়ে পাথর চাপা দিতে হয়েছে কত সহজেই।
বিদেশে যাওয়ার আগে কত কল্পনা, কত রঙিন স্বপ্ন বাসা বাঁধে হৃদয়ের গভীরে। কিন্তু বাস্তবতা যে কত কঠিন, রঙিন স্বপ্নগুলো যে কত সহজে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তা প্রবাসে না আসলে বোঝাই যায় না।
যেমন জাফর সওদাগরের কথা বলা যেতে পারে, তিনি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। বাড়ি হাটহাজারী নন্দিরহাটে। পরিবারের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে গিয়ে নিজে বিয়েটা করেছেন মধ্য বয়সে এসে। বিয়ের এক বছরের মাথায় একটা কন্যা সন্তানের পিতা হলেন। কিন্তু বিধি বাম, পিতা পুত্রের কপালে সুখ হয়ত ছিল না।
তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের স্বপ্ন ভেঙে শেষ হয়ে গেল। জোহরের নামাজের পর মসজিদেই জাফর সওদাগর হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলেন। স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে না জানি কতইনা স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সেসব স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে চলে গেলেন পরপারে না ফেরার দেশে।
রিজোয়ান ভাইয়ের কথা ভাবতেই এখনো লোম খাড়া হয়ে যায়। বয়স আর কত হবে তখন? ৩০/৩৫ বছরই হয়ত। বাড়ি হাটহাজারী মদনহাটের পশ্চিম পাশে দোলাইর পাড়া। দেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বরে রিজোয়ান কুলিং কর্নার নামে তার দোকান ছিল। সেসব ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমালেন।
কে জানত, তার হৃদয়ে কত রঙিন স্বপ্ন বাসা বেধেছিল। দুই তিন বছর যেতে না যেতেই তার বিদায় বেলা এসে হাজির। বিয়েও করেছিল, কিন্তু কোনো সন্তান হয়নি। তার আগেই আজরাইল এসে হাজির ঠিক দুপুর বেলা। সময়টা যথাসম্ভব তিনটা হবে। তখনো তিনি দোকানে কাজ করছিলেন। হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভূত হওয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় দেশটির স্থানীয় হাসপাতালে।
ততক্ষণে সব শেষ। তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। আমরা যখন হাসপাতালে দেখতে গেলাম, তখন দেখলাম তাকে শুয়ে রাখা হয়েছে। চোখ দুটি বন্ধ মুখটা হালকা ‘হা’ করা দেখে মনে হচ্ছিল হাসছেন। কিন্তু তার হাসি আর দেখা হয়নি, বন্ধ নেত্র দুটি আর কখনো খোলেনি, চেয়ে দেখতে পারেনি এই জগতকে। শেষ দেখা পায়নি মা বাবা।
দেখা পায়নি ভাই বোন, আত্মীয়-স্বজন বা প্রিয়তমা স্ত্রীর। পায়নি বিদায়কালে কোনো আপনজনের হাতে একবিন্দু জল। আহা! না জানি কত কষ্ট তার হয়েছে! যাদের স্বপ্ন বিনির্মাণে নিজের জীবনের সব স্বাদ, আহ্লাদকে পদদলিত করে প্রবাসের এমন নির্মম জীবনকে যারা গ্রহণ করে তাদের শেষ সময়ে সেসব প্রিয়জনকে কাছে না পাওয়া যে কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝবে।
কতজনের কথা বলব? কারটা রেখে কারটা বলব? এমন এক দু’জন নয় তাদের সংখ্যা অনেক। আর একজনের কথা না বললেই নয়। আমাদের সেলিম ভাই। মধ্য বয়সী সুস্থ সবল একজন মানুষ। সদালাপি, মিশুক এক মানুষ। বয়স হবে হয়ত ৪৫ বছর। নিজের দোকান নিজে করতেন। আজমান ইরানি মার্কেটে তার দোকান ছিল।
বেচারার একটাও পুত্র সন্তান ছিল না। ছিল তিনটা রাজকন্যা। সে তিন রাজকন্যাকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন। পড়ালেখা করাবেন ভালোভাবে। তারপর উপযুক্ত ঘর আর পাত্র দেখে মেয়েদের বিয়ে দেবেন। সেটা মনে হয় বিধাতার ভালো লাগেনি, স্বপ্ন দেখিয়েই সব স্বপ্ন অঙ্কুরেই শেষ করে দিলেন। বেশিদিন হয়নি এখনো তার চলে যাওয়া।
মাত্র কয়েক মাস। সেদিনও যথারীতি দোকান করেছেন। সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্রা করেছেন। রাত দশটায় দোকান বন্ধ করে রুমে যাওয়ার সময় কিনে নিয়ে গেলেন প্রিয় শাক ‘পাট শাক’। নিজের পছন্দমত ডাল আর শুঁটকি দিয়ে রান্না করে রাতে খেলেন। কিন্তু সে খাওয়া যে তার জীবনের শেষ খাওয়া হবে সেটা কে জানত? রাতে খেয়ে গভীর ঘুমে ঘুমালেন। জীবনের শেষ ঘুমটা দিলেন প্রবাসে সব বন্ধনের বাইরে।
রাতেই চলে গেলেন ওপারে। যাওয়ার সময় তার কি পিপাসা পায়নি? যাওয়ার সময় তার তিন রাজকন্যাকে শেষ বারের মতো দেখতে কি জানি তার হৃদয়টা কেমন করছিল! জানি না তার মমতাময়ী মায়ের কথা কতটা মনে পড়ছিল। প্রিয়তমা বউয়ের কথা খুব কি মনে পড়েনি? হয়ত খুব মনে পড়েছে। জীবনে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হয়ত তখন ঠোঁটের কোনায় বাকা হাসি খেলা করেছে।
এত স্বপ্ন, এত কল্পনা সব এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল প্রবাসে যন্ত্রণাময় জীবনে। রাসেল, আমার রুমমেট। বাড়ি বোয়ালখালী। বয়স ত্রিশ বত্রিশ হবে হয়ত। এমনিতে দেখতে লাজুক। কিন্তু প্রেমিক ছিল বটে। বিদেশে আসার আগে থেকে প্রেম করত। সে প্রেমের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। বিয়ের পর তিনমাস দেশে থেকে আবার চলে আসতে হলো প্রবাসে মা বাবা ভাই বোন ও প্রাণের প্রিয়তমা স্ত্রীকে রেখে।
প্রথমবার কোনো সন্তান হয়নি। দ্বিতীয়বার তাদের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। তারপর দীর্ঘ ছয় বছর বেচারা দেশে যায়নি। বউটা হয়ত খুব দুঃশ্চিন্তা করত। আর সে জন্যই হয়ত সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। যাকে ভালোবেসে জীবন সাথী করল বিধাতা তার সে ভালোবাসাকে কেড়ে নিলেন টিউমার দিয়ে।
দীর্ঘ ছয় বছর পর এক প্রেমিক তার প্রেমিকার সান্নিধ্যে যাবে। এক পতি তার প্রিয়তমা পত্নীর কাছে যাবে, এক পিতা তার না দেখা সন্তানের কাছে যাবে, তাদের স্বপ্নের কি কোনো সীমা পরিসীমা ছিল? সবাই যার যার মতো করে হৃদয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছিল তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। যথাসময়ে রাসেল দেশে গেল। এক মাসের মাথায় ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় তার প্রিয়তমা স্ত্রী চলে গেল না ফেরার দেশে। কবর রচিত হলো এক সফল ভালোবাসার।
রাসেল তার ভালোবাসা, তার অর্ধাঙ্গীকে হারিয়ে পাগল প্রায়। এখনো নিজেকে সামলে নিতে পারেনি। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বেঁচে আছে, তার ভালোবাসার হাজারো স্মৃতি নিয়ে। সবাই দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু সে করেনি। হয়ত পরে কোনো এক সময় করতে হবে বিয়ে। জীবনের তাগিদে, সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু তার প্রেম ভালোবাসার এত দিনের স্মৃতি কি ভুলতে পারবে?
পারবে কি তার ভালোবাসা হারানোর কষ্ট, যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে? সে ভুলতে পারুক বা না পারুক এই নিষ্ঠুর পৃথিবী, এই সমাজ ব্যবস্থা ঠিকই পারবে। তারপরও বেঁচে থাকতে হবে, স্বপ্ন ভেঙে যাবে জেনেও স্বপ্ন দেখতে হবে। এটাই নিয়তি। জগতের সব বন্ধন দৃঢ় থাকুক। সবার প্রয়োজন যেন সবাই বুঝতে সক্ষম হয়। সব প্রিয়জন যেন সুখে থাকে। জীবনের প্রতিটা বিসর্জন যেন স্বার্থক হয়।
লেখক: মুনির উদ্দিন, সৌজন্যে- জাগো নিউজ