‘প্রকল্প ছিল ১০৪ কোটি টাকার। শেখ ফজলুল হক মনি স্টেডিয়াম সংস্কারে খরচ চার কোটির কিছুটা বেশি। এটাই কাজে এসেছে। বাকি যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়, এর পুরোটাকেই বলব বিগ জিরো। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের এত বড় মাঠ, সুইমিংপুল বা মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করা আমাদের জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অকেজো পড়ে আছে সব’—ক্ষোভ নিয়েই বলছিলেন গোপালগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম বি সাঈফ।
তাঁর ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ আছে। আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে যা যা থাকা দরকার তার সবই আছে গোপালগঞ্জ বিসিক নগরীতে ১০ একর জায়গার ওপর নির্মিত শেখ কামাল স্টেডিয়ামে। একসময় মাঠটি ছোট থাকায় ফুটবল লিগ ছাড়া কিছু করা কঠিন ছিল। ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যাপক সংস্কারে সেই স্টেডিয়ামই পেয়েছে আন্তর্জাতিক রূপ। স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সের মধ্যেই ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে সুইমিংপুল ও জিমনেশিয়াম। পাঁচ কোটি টাকার প্রেস বক্সে একসঙ্গে বসে ম্যাচ কভার করতে পারবেন ২০০ সাংবাদিক। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর এই প্রেসবক্স দূর থেকে দেখলে মনে হবে পুরনো যুগের ডেস্কটপ। উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থার পাশাপাশি আছে রাতে ম্যাচ পরিচালনার জন্য ফ্লাডলাইট।
পার্কিং পয়েন্টে একসঙ্গে পার্ক করা যাবে ২০০টি প্রাইভেট কার। ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই স্টেডিয়ামের আধুনিকায়নের পাশাপাশি মহিলা কমপ্লেক্স নির্মাণ ও শেখ ফজলুল হক মনি স্টেডিয়ামের সংস্কার করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। কিন্তু ভবন নির্মাণ করেই তারা দায়মুক্তি পেয়েছে যেন। এটা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করা এত কম লোকবল নিয়ে অসম্ভব জেলা ক্রীড়া সংস্থার। এ জন্যই শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রায় সব এসি নষ্ট। অকেজো পড়ে আছে ঘাস কাটার মেশিন। ঘাসও তাই ‘ধানগাছের’ মতো বড়।
অনেকটা আলোর নিচে অন্ধকারের মতো। স্টেডিয়াম নির্মাণ শেষে আর মাঠের দিকে নজর দেয়নি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। তাই অসমতল পুরো মাঠ। এই মাঠে আর যা-ই হোক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সম্ভব নয়। উন্নত আবাসন না থাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে বারবার তাগাদা দিয়েও পাওয়া যায়নি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এম বি সাঈফের হতাশা এ জন্যই। এখন তিনি দায়িত্বে নেই। সামনে নির্বাচন বলে জেলা ক্রীড়া সংস্থা চলছে অ্যাডহক কমিটি দিয়ে। নির্বাচনের পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আন্তরিক না হলে দায়িত্বে যিনিই আসুন এই স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, বিপিএল এমনকি প্রথম বিভাগ ক্রিকেটও সম্ভব নয়। অথচ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেলা গোপালগঞ্জ। বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও জেলা এটা। তবু আলোর নিচ থেকে অন্ধকার দূর না হওয়ায় আকুতিই জানালেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সহসভাপতি ফখরুল ইসলাম ভিকু, ‘কত জায়গা ধরনা দিয়েছি আমরা। কোনো কাজ হচ্ছে না। একটা ডরমিটরি আর ইনডোর ভীষণ দরকার। অনুশীলনের জন্য আউটডোরের সংস্কার করতে হবে। ঘাস কাটার মেশিন দরকার আর খুব বেশি দরকার গ্রাউন্ডসম্যান। না হলে স্টেডিয়াম অকেজো হয়ে পড়বে। স্থানীয় লিগ অনিয়মিত হয়ে আছে, এটা প্রতিবছর করা দরকার। আমরা নিজেদের প্রচেষ্টায় অসমতল মাঠ জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করে টায়ার ওয়ান, টু ক্রিকেট করেছি। কিন্তু এভাবে এত বড় একটা স্থাপনা চলতে পারে না।’
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এখানকার সুইমিংপুলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রায় সাত মাস অব্যবহৃত থাকার পর ঢেউ ওঠে জলে। ২৭তম জাতীয় সাঁতার অনুষ্ঠিত হয় গোপালগঞ্জে। ঢাকার বাইরে জাতীয় সাঁতার হয়েছে এই জেলাতেই প্রথম। সেদিক থেকে ইতিহাস গড়েছে গোপালগঞ্জ। এই টুর্নামেন্টের জন্য পানি সরবরাহের কাজ করেছিল স্থানীয় পৌরসভা আর তাতে প্রায় চার দিন পানিসংকটে পড়ে পুরো জেলা সদর! সুইমিংপুল নির্মাণের সময় ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করে পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা না করাতেই এমন দুর্দশা। তা ছাড়া পানির লেয়ারের কারণে চলে আসে আয়রন আর লালচে হয়ে পড়ে পানি। আয়রনের পরিমাণ এত বেশি যে ফিল্টার মেশিনেও কাজ হওয়ার নয়। পাশের লেক থেকে পানি আনার পরিকল্পনা করা হলেও বাস্তবায়ন হয়নি সেটা। সুইমিংপুলে পানি নেই তাই। এম বি সাঈফের ক্ষোভের কারণ এটাই, ‘এভাবে চললে আমার তো মনে হয় না, সুইমিংপুলে কখনো পানি আসবে।’
টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের গৌরব শেখ হাসিনা। তাঁর এলাকায় এমন একটি স্টেডিয়ামের শ্বেতহস্তী হয়ে থাকাটা অবিশ্বাস্যই! কালের কণ্ঠ