মোহাম্মদ আল আমিন, সিউল, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪:
এক.
বাঙালি একটি বিষয়ে একমত আর তা হলো ‘কোন একটি বিষয়ে তারা কখনোও একমত হবেনা’। এটি সেই আদি কালের কথা,অনেক পুরনো প্রবাদ। নতুন কথা হলো বিপরীত মতের কেউ থাকলে তাকে ধরো মারো কাটো। গুম, খুন অথবা মাঝ রাতে হাওয়া করে ফেলো! সেটা জোর খাটিয়ে হোক অথবা কৌশল করে হোক।
ভাই হয়ে ভাইয়ের মাথা ফাটাতে এখন আমরা কার্পণ্য করি না। বিভেদ সৃষ্টি যেন আমাদের ‘ইনহেরিটেড’ স্বভাব। মানুষ এখন আর অর্ধাহার অনাহারে মারা যায় না। মারা যায় হরতাল আর ক্রস ফায়ারে। মারা যায় পান-বিড়ি-সিগারেটের মত গুলি খেয়ে।
মাথা পিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে অশান্তিও জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশে। তাই প্রয়াত বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম আক্ষেপ করে বলেছেন ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!’ তার মানে কী এখনকার দিন সুন্দর নয়? না, এখনকার দিনও সুন্দর তবে সবার জন্য নয়। বিশেষ কারো কারো জন্য। আজকাল দিন সুন্দর করতে হলে পয়সা লাগে। আবার পয়সা বানাতে ক্ষমতা লাগে। ক্ষমতা পাওয়ার জন্য রাজনীতি অপরিহার্য।
শুধু অতীতকালে নয় বর্তমানেও সভ্য সমাজে যারা রাজনীতি করেন তাদের একটা নীতি থাকতে হয়। বাংলাদেশ এর ব্যাতিক্রম। বৃটেনের কোন রাজনীতিবিদ যদি নারী কেলেংকারীর সাথে জড়িত হয়, সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথেই তিনি পদত্যাগ করেন। অর্থ কেলেংকারী হলে তো কথাই নেই!
আর আমাদের দেশে নারী কেলেংকারী আর অর্থ কেলেংকারী হলো রাজনীতিবিদদের বিশেষ অলংকার। বস্তা ভর্তি টাকাসহ হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পরেও দাঁত কেলিয়ে হাসে। এসব না হলে সমাজে প্রভাব সৃষ্টি করা যায় না। পত্রিকার পাতায় ছবি আসেনা। বড় বড় নেতা হতে গেলে এসব অলংকার কিছুটা হলেও লাগে।
প্রবাদ আছে ‘দুষ্ট লোকের কারণে সমাজ নষ্ট হয়না,সমাজ নষ্ট হয় ভালো মানুষদের নীরবতায়। এখনকার সমাজে যাদেরকে আমরা ভালো মানুষ বলে জানি,শুনেছি তাদের মাথাও বেচাকেনা হয়। একেক জনের মাথার মূল্য কোটি কোটি টাকা। আর যারা মাথা বিক্রি করতে চায়না তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নতুবা তাদেরকেই ভিলেন বানিয়ে রাখা হয়।
যতদিন ভালো মানুষেরা দূরে থাকবে ততদিন সমাজ বা রাষ্ট্রের ইতিবাচক কোন পরিবর্তন হবেনা। একথা রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অফিসের পিওন কেরানি পর্যন্ত প্রযোজ্য। গত ২৩ ফেব্রুয়ারী সিউলে বাংলাদেশ কমিউনিটির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জনাব এনামুল কবির সাহেব বললেন রাষ্ট্র এগিয়ে গেলে তার সুফল প্রবাসে বসেও পাওয়া যায়। কথাটি তিনি অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বর্ণনা করেছের এবং শতভাগ খাঁটি কথা। অসভ্য সমাজের কেউ প্রবাসে গিয়েও শান্তিতে থাকতে পারেনা, সবাই বাঁকা চোখে তাকায়। আমরা সভ্য হলে বিদেশের কোন ইমিগ্রেশনে ঘন্টার পর ঘন্টা বিনা কারণে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা। অযথা হয়রানির স্বীকার হতে হবেনা। বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখে বাঁকা চোখে তাকাবেনা ইমিগ্রেশন অফিসার।
দুই.
প্রবাসী বাংলাদেশীরদের মাঝে দলীয় কোন্দলে প্রায়ই কিঞ্চিত হাত গরমের প্র্যাকটিস চলে,সেটি নতুন কিছু নয়। এই তো সেদিন ২১ শে ফেব্রুয়ারী প্রভাত ফেরীতে শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে লন্ডনের আলতাফ আলি পার্কে এক ম্যাচ হয়ে গেলো। একই দলের মধ্যে যেখানে মারামারি,সেখানে সব দলের নেতা কর্মীদেরকে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু!
হ্যাঁ, এমনই এক দুঃস্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু উদ্যমী মানুষ প্রায় এক বছর পূর্বে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন “বিভেদ নয় অপরের মতামতকে শ্রদ্ধা করে একই ছায়া তলে থাকতে চাই আমরা। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবার লক্ষ্যে সবাইকে নিয়ে একটি ‘কমন প্লাটফর্ম’ তৈরি করা এখন সময়ের দাবী। যেখানে ইপিএস কর্মী, ছাত্র সমাজ,ব্যবসায়ী এবং প্রফেশনাল সহ সকল শ্রেনী-পেশার বাংলাদেশী নাগরিকদের সম্মিলন ঘটবে”।
এসব শুনে পিছনে থেকে অনেকেই হয়তো টিকা টিপ্পনী কেটেছে এবং মুখ টিপে হেসে বলেছে ‘আরে যা ওসব কত দেখলাম’! কিন্তু ঐ সব উদ্যমী মানুষ ভেঙ্গে পড়েনি নিন্দুকের কথায়। কাউকে না কাউকে শুরু করতে হবে এই কাজ। অনেক আশা আর সম্ভাবনা নিয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ সিউলে কেইবি ব্যাংক এর একটি হল রুমে সবার মতামতের ভিত্তিতে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন কোরিয়া’ বিসিকে নামক একটি কমন প্লাটফর্ম গঠিত হয়। মাননীয় রাষ্ট্রদূত মহোদয়কে প্রধান উপদেষ্টা করে পূর্নাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয় দুই বছরের জন্য। সভাপতি এবং সেক্রেটারী নির্বাচিত হয় গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে কোন টু শব্দ ছাড়াই যেদিন কমিটি গঠিত হল। দূর থেকে নিন্দুকেরা বলতে লাগলো ‘দেখিনা কত দিন টেকে এই সব ভুং ভাং’!
তার পরেও আশাহত নই আমরা। এগিয়ে যেতে হবে। শুধু আমার জন্য নয়, আমার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। পিছনে তাকাবার সুযোগ নেই, যেতে হবে অনেক দূর। এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে পথ চলা শুরু হোক বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন কোরিয়ার। শুভ কামনা রইলো বিসিকে’র জন্য। অন্যরা যা করতে পারেনি তা করে দেখাতে পারে বিসিকে।
লেখকঃ পিএইচডি গবেষক, কনকুক বিশ্ববিদ্যালয়, সিউল।