গত ৯২ বছর ধরে ভারতের চেন্নাই থেকে একটানা প্রকাশিত হয়ে আসছে উর্দু দৈনিক ‘দ্য মুসলমান’। এটি বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা সংবাদপত্র। ১৯২৭ সালে প্রথম প্রকাশের সময় যেমনটা ছিল অবিকল সেভাবেই এখনও নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে এই পত্রিকাটি।
১৯২৭ সাল, ভারতবর্ষ তখনও ইংরেজদের অধীনে। সাইয়্যেদ আজাতুল্লাহ নামের এক মুসলমান বাস করতেন দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইতে। আজাতুল্লাহ ছিলেন শিক্ষিত ব্যক্তি, হিন্দি, উর্দু আর ফারসী ভাষায় দারুণ দক্ষতা ছিল তার। তিনিই প্রথম অনুভব করলেন, মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র একটা পত্রিকা থাকা খুব দরকার, যেখানে মুসলমানদের দাবী-দাওয়াগুলো উঠে আসবে, তাদের বঞ্চনার কথা লেখা হবে, যেখানে ধর্ম আর ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে লিখবেন পণ্ডিত ব্যক্তিরা। সেই ভাবনা থেকেই হাতে লেখা সংবাদপত্র হিসেবে সেবছর যাত্রা শুরু হলো ‘দ্য মুসলমান’-এর।
এই বিরানব্বই বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু ‘দ্য মুসলিম’ বদলায়নি, সরে আসেনি তার প্রাচীন অবস্থান থেকে। একই ধারা বজায় রেখেছে পত্রিকাটি। বংশানুক্রমে এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন সাইয়্যেদ বংশের উত্তরসূরীরাই। সাইয়্যেদ আজাতুল্লহার মৃত্যুর পরে সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার ছেলে সাইয়্যেদ ফাজলুল্লাহ। ২০০৮ সালে ফাজলুল্লাহ’র মৃত্যু হলে তার একমাত্র সন্তান এবং সাইয়্যেদ আজাতুল্লাহ’র নাতি সাইয়্যেদ আরিফুল্লাহ পান সম্পাদকের দায়িত্ব। তারপর থেকে এই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকাটির মূল আকর্ষণ এর অসাধারণ ক্যালিগ্রাফি। খবর সাজানোর পাশাপাশি রঙ, তুলির বৈচিত্র্যে নানা ক্যালিগ্রাফি ফুটিয়ে তোলার কাজ করেন তিনজন ‘কাতিব’। রং আর বিভিন্ন কলম ও তুলি দিয়ে লেখা হয় শিরোনাম ও ছবির ক্যাপশন। তবে এখানে কোন খবরেরই বাইলাইন নেই।
চার পাতার কাগজের প্রথম পাতায় থাকে দেশ ও বিদেশের খবর। দ্বিতীয় পাতায় শুধুই সম্পাদকীয়। পরের পাতা দু’টিতে স্থানীয় খবর ও বিজ্ঞাপন। সম্পাদক সাইয়্যেদ আরিফুল্লাহ জানিয়েছেন, ব্রেকিং নিউজ সাধারণত এই দৈনিকে প্রকাশিত হয় না। কারণ এজন্য অনেক সময়, পরিশ্রম ও লোকবলের প্রয়োজন। মূলত সমাজের নানা বিষয়ের উপরই জোর দেওয়া হয় এই সংবাদপত্রে। ইসলামভিত্তিক খবর প্রথম পছন্দ হলেও সবরকম পাঠকের জন্যই খবর থাকে এখানে।
চেন্নাইয়ের ট্রিপলিকেন হাই রোডে দু’কামরার ছোট্ট দু’টি ঘরে প্রথম কাজ শুরু হয় ‘দ্য মুসলমান’-এর। চার পাতার কাগজটির সব খবর সাজিয়ে দেন আরিফুল্লাহ। এরপর রঙ-তুলি দিয়ে ক্যালিগ্রাফির কাজ শুরু করেন মুখ্য ‘কাতিব’ রহমান হোসেইনি। ১৯৮০ সালে তিনি এই পত্রিকায় যোগ দেন, এখনো নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মাসিক বেতন ২ হাজার ৫০০ টাকা। খবর লেখার দায়িত্বে রয়েছেন শাবানা ও খুরশিদ বেগম। প্রতিটি পাতা সাজানোর জন্য দিনে ৬০ টাকা করে বেতন পান তাঁরা।
দৈনিকের কাজ শুরু হয় সকাল ১০টা থেকে। দু’জন অনুবাদক খবরগুলো উর্দু ভাষায় লিখে দেন। ঘণ্টা দু’য়েক ধরে অনুবাদের কাজ চলে। তারপর ক্যালিগ্রাফি ও লেখার কাজ শুরু করেন তিন ‘কাতিব’। তারপর যুক্ত করা হয় বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান যদি ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের ফাইল প্রদান করে তাহলে সেগুলোও ক্যালিগ্রাফাররা হাতে এঁকে পত্রিকায় সংযুক্ত করে দেন। মূল কপি তৈরি হয়ে গেলে দুপুর ১টা নাগাদ প্রিন্টের মাধ্যমে বাকি কপিগুলি তৈরি হয়। সন্ধ্যার মধ্যে খবরের কাগজ পৌঁছে যায় প্রায় ২২ হাজার পাঠকের হাতে। চেন্নাই ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে আছে এই পত্রিকার গ্রাহক। দূরের পাঠকদের ডাকের মাধ্যমে পত্রিকা পৌঁছে দেয়া হয়।
চার পৃষ্ঠার এই সংবাদপত্রটির দাম মাত্র ৭৫ পয়সা, বাংলাদেশী টাকায় যেটা মোটামুটি এক টাকার সমান। সাইয়্যেদ পরিবারের আয়ের মূল উৎস হচ্ছে প্রেসের ব্যবসা। এছাড়া পত্রিকায় আসা বিজ্ঞাপন থেকেও কিছু আয় হয়। ‘দ্য মুসলিম’ কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয় না, মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা থেকে দাদা সাইয়্যেদ আজাতুল্লাহ যে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, বংশ পরম্পরায় সেটা টিকিয়ে রেখেছেন উত্তরসূরীরা। ঐতিহ্যের সাথে তারা ব্যবসাকে মেলাতে চান না।
সূত্র: দ্য হিন্দু, দৈনিক আনন্দবাজার