কি শহর, কি গ্রাম, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের হার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ঢাকার বাইরে অন্যান্য সাত বিভাগেও এই হার উদ্বেগজনক। আশঙ্কার বিষয় সংসার ভাঙার এই হার বিভাগীয় শহরগুলোতে বছর বছর বাড়ছে। আর নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষই বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন। শিক্ষিত ও কর্মজীবীদের মধ্যে বিচ্ছেদের হার তুলনামূলক বেশি। আর নারীদের বিচ্ছেদের আবেদন করার হার পুরুষদের তুলনায় বেশি। আবার আইনি প্রক্রিয়ায় না গিয়েও অনেকে এখন আলাদা থাকছেন বা সেপারেশনে যাচ্ছেন।
এক হিসাবে দেখা যায়, বিভাগীয় শহরে বিচ্ছেদের হার ৪৯.০৩ শতাংশ আর জেলা শহরে ৩৫.৫ শতাংশ। বিবাহবিডি ডটকম নামের বেসরকারি বিবাহ সম্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ নির্ণয়’ শিরোনামে প্রশ্নভিত্তিক এক জরিপ পরিচালনা করে। এতে ৪১২ জন অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১০৪ জনই বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি বিভাগীয় ও জেলা শহরে বসবাসকারীদের মাঝে, যা যথাক্রমে বিভাগীয় শহরে ৪৯.০৩% এবং জেলা শহরে ৩৫.৫%। আর উচ্চশিক্ষিত নাগরিকদের মাঝে বিচ্ছেদের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। এ ছাড়া একক পরিবারে থাকা দম্পতিদের যৌথ পরিবার থেকে আসা দম্পতিদের তুলনায় বিচ্ছেদে যাওয়ার হার বেশি।
বিচ্ছেদের কারণের মধ্যে যে বিষয়গুলো জরিপে উঠে এসেছে সেগুলো হলো- পরকীয়া, ভুল বোঝাবুঝি, সাংসারিক দায়িত্ব পালনে অনীহা, সঙ্গীকে মূল্যায়ন না করা, মাদকাসক্তি, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, সন্দেহ প্রবণতা, শ্বশুরবাড়ির লোকদের দুর্ব্যবহার, সন্তান ধারণে অক্ষমতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি। এমনকি ‘এন ওভারভিউ অফ দ্য ইফেক্টস অব ডিভোর্স অন কালচার অ্যান্ড সোসাইটি উইদিন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রবন্ধেও উল্লেখ করা হয়, গ্রামাঞ্চলে কম বয়সে বিয়ে হয় অনেকের। এর ফলে বিচ্ছেদের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও সমাজবিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করে শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছেদের বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা গিয়েছে। এগুলো হলো- মাদকাসক্তি, স্বামী-স্ত্রীর জীবন যাপনে অমিল, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, নারীর পেশাগত উন্নয়ন এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন। এ ছাড়াও যৌতুক ও বাল্যবিবাহ বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। এক সময় পরিবারের কথা চিন্তা করে ও সামাজিক লোকলজ্জার জন্য আপস করে সংসার করলেও নারীরা এখন তারা আপসে রাজি নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকাতে গড়ে প্রতিদিন ৫০টির ওপর বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে। সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বিচ্ছেদের নোটিস পাঠানো হয়েছে ২৪ হাজার ৯১২টি। এর মধ্যে পুরুষরা পাঠিয়েছে আট হাজার ৯৬টি এবং নারীরা ১৬ হাজার ৮১৬টি। অর্থাৎ নারীরা পুরুষের থেকে দ্বিগুণ বিচ্ছেদের আবেদন করছেন। আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) হিসাবে প্রতি দুই ঘণ্টায় সেখানে একটি করে সংসার ভাঙছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চসিকের তথ্যে, সেখানে এক হাজার ৫৭৯টি বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়। আর প্রতি মাসে গড়ে ৩৮৪টি আর প্রতিদিন গড়ে ১৫টি বিচ্ছেদের আবেদন করা হচ্ছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আবেদনকারীর মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে, দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহীতে। প্রতি হাজারে সেখানে এক দশমিক ৯ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। রাজশাহীর পরপরই সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হচ্ছে খুলনায়। সেখানে প্রতি হাজারে এক দশমিক ৩ জন বিচ্ছেদের আবেদন করছেন।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্যে, বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সালিশি বোর্ডের কর্মকর্তারাও হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের মতে, মাত্র ২ শতাংশ দম্পতি সালিশি বৈঠকে আসেন। তারা আরও জানান, বিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর দুই পক্ষকে প্রতি মাসে শুনানির জন্য ডাকা হলেও ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো পক্ষ সিটি করপোরেশন অফিসে আসেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেকে নিজের পেশাজীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে আগের চেয়ে বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সৌজন্যে- বাংলাদেশ প্রতিদিন