যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই সাধারণ একটি বিজ্ঞাপন। সেসব বিজ্ঞাপনে যা থাকে এই বিজ্ঞাপনেও আছে একই জিনিস। বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি ওয়েবসাইটও আছে। তাতে কিছু ছবি দেওয়া আছে যাতে দেখা যাচ্ছে ক্লাস রুমে বসে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে।
লাইব্রেরিরও কিছু ছবি আছে, যেখানে বসে আছে ছাত্রছাত্রীরা। আছে ক্যাম্পাসের ছবি। সবুজ মাঠের ওপর বসে শিক্ষার্থীরা আড্ডা মারছে। এখানেই শেষ নয় এই বিশ্ববিদ্যালয়টির আছে একটি ফেসবুক পেইজও, যেখানে নানা ইভেন্টের একটি তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে।
সবকিছু ঠিকঠাক। দেখে মনে হবে আর দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এটিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আসলে তা নয়। ওয়েবসাইটে ক্লাস রুম, লাইব্রেরি আর ক্যাম্পাসের ছবি থাকলেও বাস্তবে সেরকম কিছু নেই। এটি আসলে নাম সর্বস্ব একটি ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে ইউনিভার্সিটি অফ ফার্মিংটন। কাল্পনিক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি মিশিগান অঙ্গরাজ্যে।
কাগজে কলমে আর ইন্টারনেটে এটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দপ্তর বা ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। এর পেছনে কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য হলো অবৈধ অভিবাসীদের আকৃষ্ট করে তাদেরকে আটক করা।
নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ অভিবাসীরা যে অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যেতে পারে এই অভিবাসন জালিয়াতি ধরাই ছিল তাদের এই নাটকের লক্ষ্য।
এতে সফলও হয়েছে তারা। অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সাজানো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁদে পা দিয়ে ধরা পড়েছে বহু ভারতীয় তরুণ। বলা হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মোট ১৩০ জনকে বুধবার পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং তাদের মধ্যে ১২৯ জনই ভারতীয়। তবে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত সরকার। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এই শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতারণার শিকার হয়েছে।
শনিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের কাছে এই গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও তাতে উদ্বেগ জানিয়ে গ্রেফতারকৃতদের সাথে যোগাযোগের জন্যে অনুমতি বা কনস্যুলার এক্সেস দাবি করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “এই সব শিক্ষার্থীর মর্যাদা ও তারা কেমন আছে সেটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। একারণে খুব দ্রুত তাদের সঙ্গে আমাদের কর্মকর্তাদের যোগাযোগ করতে দেওয়া উচিত।”
শিক্ষার্থীরা কিভাবে কোথায় ভর্তি হয়েছিল এবং তাদের পরিচয় কী- এবিষয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিস্তারিত তথ্যও জানতে চেয়েছে। একই সাথে দাবি জানিয়েছে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়ারও।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কৌসুলিরা বলছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন তারা জানতেন যে এখান থেকে তারা যেসব সুবিধা নিচ্ছিলেন সেগুলো অবৈধ।
ভুয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তৈরি করা হয় ২০১৫ সালে। উদ্দেশ্য ছিল যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী স্টুডেন্টস ভিসা নিয়ে আগেই যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন কিন্তু ওই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নানাভাবে দেশটিতে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তাদেরকে ফাঁদে ফেলা। এজন্যে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়। গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্যে এক বছরে ৮,৫০০ এবং আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের জন্যে ১১,০০০ ডলার চাওয়া হয় সেখানে।
আসলে এর সবটাই সাজানো। পরে আদালতের যেসব কাগজপত্র প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যায় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যারা চাকরি করেন তারা আসলে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস বিভাগের গোয়েন্দা কর্মকর্তা যারা তাদের নাম পরিচয় গোপন করেছেন। আর যে ক্যাম্পাসের ছবি দেওয়া হয়েছে সেটি ডেট্রয়েটের শহরতলিতে একটি অফিসের ছবি।
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে তাদেরকে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে তাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতে ফেরত না পাঠানোর জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভারতের একটি পত্রিকা জানিয়েছে, আটক এসব শিক্ষার্থীর উদ্বিগ্ন আত্মীয় স্বজনরা যাতে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন সেজন্যে ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসে একটি টেলিফোন হট-লাইনও স্থাপন করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। এর আগেও ২০১৬ সালে বারাক ওবামার সময়ে নিউ জার্সিতে একই ধরনের একটি ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ২১ জনকে আটক করা হয়েছিল যাদের বেশিরভাগই ছিল চীনা ও ভারতীয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর গত দুবছরে অবৈধ এসব অভিবাসী এবং যারা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্রে থেকে গেছেন তাদের পাকড়াও করতে কর্তৃপক্ষের অভিযান আরো জোরদার হয়েছে।
সৌজন্যে- বিবিসি বাংলা