দেশ থেকে একটা মানুষ প্রবাসে গিয়ে কি খুব ভালো থাকে? না, দেশ থেকে সবকিছু ছেড়ে যেমন তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যখন প্রবাসে একা একটা মানুষ যায় তখন তার মনটা কিন্তু পড়ে থাকে দেশের মাটিতেই। মনে পড়ে তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানের কথা।
স্বজনদের চেহারা বার বারই মনে পড়ে। কাজ করতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে আসতে। কিন্তু না, সময় এবং পরিস্থিতি তা করতে দেয় না, কেননা বিদেশ থেকে দেশে এসে পড়ি তবে আপন মানুষগুলো অর্থকষ্টে ভুগবে, তিনবেলার খাবার একবেলা খেতে হবে, কোনো কোনো সময় আবার না খেয়েই থাকতে হবে।
এটা চোখের সামনে ঘটলে সহ্য করতে পারবে না। তাই শত যন্ত্রণার পরও দেশের মানুষটি প্রবাসে থাকে তার কষ্ট হলেও যাতে তার প্রিয় মানুষগুলো একটু ভালো থাকে, একটু স্বস্তিতে থাকে, একটু সুন্দর থাকে, সে যেন পরবর্তীতে দেশে ফিরে সে মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখতে পারে। আহা, তার কাছে তখনই পরম শান্তি বলে মনে হয়। মনে হয় এই মুহূর্তটার জন্যই তো দেশের বাইরে থাকা, খানিক কষ্ট করা।
আব্দুল মালেক টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার সুজামুরি গ্রামের মো. মুচারবের ছেলে ২০০৭ সালের কলিং ভিসায় অ্যালমুনিয়াম কোম্পানিতে মালয়েশিয় আসেন। দীর্ঘদিন কাজ করেন কোম্পানিতে। ৩ বছরপর আর ভিসা করেনি কোম্পানি। বাধ্য হয়ে কোম্পানি থেকে ফেরা হয়নি। পরে রি-হিয়ারিং এর আওতায় বৈধতা লাভ করেন কিছুদিন হলো। কাজ করেন মুরগী কাটার দোকানে।
মাসে বেতন পান ১২ শ রিংগিত তা দিয়ে চলে না। পার্ট টাইম কাজ করেন পুত্রাযায়া একটি কাপড়ের দোকানে সেখান থেকে আসে আরো এক হাজার রিংগিত। সর্বমোট মাস শেষে ২২শ রংগিত পান। সেখান থেকে নিজের খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা দেশে পাঠিয়ে দেন। ইচ্ছে করলেও নিজের আরাম আয়েশ ছেড়ে বীর দর্পে কাজ করে চলেছেন আব্দুল মালেক।
কারণ দেশে দুটি জমজ মেয়ে সন্তান চিনহা/চিন্তা, স্ত্রী, মা-বাবা রয়েছেন। তাদেরকে সুখে শান্তিতে রাখতে এই কষ্ট। আবদুল মালেকের মত হাজারো আবদুল মালেক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করে যাচ্ছেন।
আমরা আসলে জানি না একটা দেশের ছেলে অন্য আরেকটা দেশের মাটিতে কেমন কষ্ট করে আয়-উপার্জন করে! এই বিষয়গুলো আমাদের জানারও তেমন বিষয় নয়, কেন নয়? এই বিষয়গুলো জানা কি আমাদের দরকার নয়! নাকি এই বিষয়গুলো পাথর চাপা দেয়ার মতো কোনো বিষয়! না, দেশে থেকে একটা মানুষ বুকে কতটা কষ্ট নিয়ে দেশের বাইরে যায় তা হয়তো যে মানুষটা যায় সে মানুষটার থেকে ভালো আর কেউ বলতে পারবে না বা জানে না।
কেননা দেশ থেকে একটা মানুষ সুস্থ অবস্থায় বিদেশে গেল ঠিকই সে মানুষটা বিদেশ থেকে অসুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে দেশে। তখন তার প্রিয়গুলোর কষ্ট হয় কিন্তু প্রিয় মানুষ ছাড়া বাইরের কোনো মানুষের কষ্টের লেশমাত্র হয় না। কেননা সে মানুষটা তো শুধু তার আপন মানুষগুলোর জন্যই কষ্ট করছে। তা ভুল! সে মানুষটা কষ্ট করছে একটি দেশের জন্য, একটি দেশের মানুষের জন্য, একটি দেশের সতেরো কোটি জীবনের জন্য, জীবনগুলোর বেঁচে থাকার জন্য।
প্রবাসে থাকা একজন মানুষের সবচেয়ে বড় যে টান তা হলো নাড়ির টান। এই টানের কারণেই একজন প্রবাসীকে দেশ নিয়ে ভাবায়, ভাবায় তাকে ভালো কিছু নিয়ে তার দেশের কাছে, তার নাড়ির কাছে ফিরতে হবে। নইলে তার প্রবাস জীবন ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার কারণে কেউ কেউ দেশ ত্যাগই করে না, জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করে। এটা আসলে একটা হতাশার কারণ।
প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের কথা যদি বলি তবে আমি বলব তাদের কোনো সুখ নেই বরং দুঃখেরও কোনো শেষ নেই। কেননা তারা না ঘুমিয়ে, সময়মতো না খেয়ে, ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
প্রবাসে কী কেউ সুখের জন্য যায়? না প্রবাসে কেউ নিজের সুখের জন্য যায় না বরং অন্যের সুখটা দেখার জন্য প্রবাসে যায় দেশ ছেড়ে। তারা তাদের অর্জিত কাক্সিক্ষত সম্পদ দিয়ে যখন প্রিয় মানুষগুলোর জন্য প্রিয় কিছু নিয়ে আসে তখন তাদের ভালো লাগে বরং আনন্দ হয় যখন কিনা তারা বুঝতে পারে, দেখতে পারে তাদের প্রিয় মানুষ, কাছের মানুষের আনন্দ তখন তারা রীতিমতো অবাক হয়, বিস্মিত হয়।
আমাদের দেশটা যে কারণে পেছনে পড়ে আছে তা হলো দেশের মানুষগুলোর মন ও মানসিকতা এখনো খুব নিচু হয়ে আছে। যে দেশ নিচু মনমানসিকতার মানুষ লালন করে সে দেশ কী করে এগিয়ে যাবে বা তার যোগ্য অনুযায়ী কর্ম দেবে, তা কখনোই সম্ভব নয়। তা এখনো অবাস্তব আমাদের দেশে। এটা কখনো বাস্তব হওয়ার নয়।
কেননা আমার দেশের সরকার যদি এই বিষয়টা নিয়ে একটু কাজ করত তাহলে হয়তো আমার দেশের মানুষেরা এই দেশ ছেড়ে প্রবাসে যেত না বা তাদের নিজ নিজ দেশে তারা কর্মসংস্থানের খোঁজে এগিয়ে আসত। কিন্তু না, তা এখনো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি আমার দেশে বা সম্ভবপর হয়ে উঠবেও না কখনো।
লেখক- মো. মুখলেছুর রহমান (মুকুল), আহমাদুল কবির
সৌজন্যে- জাগো নিউজ