ঢাকা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে ভয়াবহ চেক জালিয়াতির চেষ্টা হয়েছে। ব্যাংক ম্যানেজারের বিচক্ষণতায় জমি অধিগ্রহণের প্রায় আট কোটি টাকা অল্পের জন্য বেহাত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে এ বিপুল পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে চলে যায়।
ঘটনাটি ডিসি অফিসের সিনিয়র সহকারী কমিশনারকে দিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তদন্ত করে ডিসি অফিসের এলএ শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক আবু বকর সিদ্দিককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া অধিকতর তদন্তের জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসন নথিপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছে।
এদিকে এ চেক জালিয়াতির পরপরই ইউএনও পদে পদায়নের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবদুল কাদির মিয়াকে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ন্যস্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আর এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী কমিশনার রুনা লায়লাকে পাঁচ মাসের প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি মাসের প্রথমদিকে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের রাজধানীর ডুমনী শাখায় আমিনুল ইসলাম আমিনের (পিতা নুরুল ইসলাম মোল্লা, বাসা-জিপিপি/৮, দক্ষিণ বাড্ডা, গুলশান-১২১২) নামে দুটি চেক জমা পড়ে। একটি চেকে (এলএ কেস নং ২১/২০১৫-২০১৬ এর চেক নং-০৫৫৯৪৪, ক্ষতিপূরণ রোয়েদাদ তালিকা নং-২১, তারিখ ২৪-১২-১৮) চার কোটি ১৮ লাখ ২০ হাজার ৩৫০ টাকা ৭০ পয়সা এবং অপর চেকে (চেক নং-০৫৫৯৪৫, ক্ষতিপূরণ রোয়েদাদ তালিকা নং-২০, তারিখ ২৪-১২-১৮) তিন কোটি ৪৫ লাখ ২৬ হাজার ৫১০ টাকা ৩০ পয়সা উল্লেখ করা হয়। দুটি চেকে টাকার পরিমাণ সাত কোটি ৬৩ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬১।
বিষয়টি ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার ইসমাইল হোসেনের সন্দেহ হলে ৬ জানুয়ারি পিয়ন মারফত চেক দুটির ফটোকপি তিনি ঢাকা ডিসি অফিসের সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠান। সেখানে উল্লিখিত দুটি চেকের তথ্য এডওয়ার্ড বইয়ের সঙ্গে কোনো মিল নেই। এমনকি চেকের স্বাক্ষর তার নয় বলেও দাবি করেন সংশ্লিষ্ট ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবদুল কাদির।
এছাড়া চেক দুটির ক্ষতিপূরণের আবেদনেরও অনুমোদন নেই। মূলত ২০নং ক্রমিকের চেকে গত বছরের ৩ মে হানিফকে ২১ কোটি ৬৯ হাজার ২৩৮ টাকা এবং ২১নং ক্রমিকের চেকে ৩১ অক্টোবর জুয়েল আহমেদ গংকে ৫০ লাখ ৮১ হাজার ৩৩১ টাকা দেয়া হয়।
চেক জালিয়াতি নিয়ে ডিসি অফিসে তোলপাড় শুরু হলে ৭ জানুয়ারি সকালে এলএ শাখার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক আবু বকর সিদ্দিক ছুটির আবেদন দিয়ে নিরুদ্দেশ হন। এরপর অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ডিসি অফিসের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আগ্নেয়াস্ত্র শাখা) রুনা লায়লাকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে দু’দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবদুল কাদির মিয়ার চেয়ে জুনিয়র এবং তিনি কখনও এলএ শাখায় কাজ করেননি। এমনকি তদন্ত সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রমাণাদি না দেখেই তিনি প্রতিবেদন জমা দেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- অফিস সহকারী আবু বকর সিদ্দিক এককভাবে দায়ী। তিনি নিজেই চেক দুটি তৈরি করেছেন। অ্যাকাউন্টস অফিসে প্রাপককে নিজের কাছের লোক পরিচয় দিয়ে তিনি চেক দুটি অনুমোদন করিয়েছেন। তারপর সেগুলো নিজের এলাকা রাজধানীর ডুমনীর ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শাখায় তিনি জমা দেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিনা কারণে বেশ কয়েকদিন অফিসে উপস্থিত না হওয়ায়, অফিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় প্রতীয়মান হয়েছে- অফিস সহকারী আবু বকর জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে চেক দুটি সৃজন করে তা নগদায়ন করার চেষ্টা করেছেন। ১০ জানুয়ারি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে অফিস আদেশ জারি করেন ঢাকার ডিসি আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান।
পাশাপাশি একই দিন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবদুল কাদির মিয়াকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদায়নের জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ন্যস্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী কমিশনার রুনা লায়লাকে পাঁচ মাসের জন্য বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে আইন ও প্রশাসন কোর্সে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার তিনি ডিসি অফিস থেকে বিদায় নেন বলে জানান রুনা লায়লা।
এত বড় চেক জালিয়াতির ঘটনা একজন অফিস সহকারী ঘটিয়েছেন, এটা মানতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এটি একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ। একা কারও পক্ষে এত বড় জালিয়াতি করা সম্ভব নয়।
ঢাকা ডিসি অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় অভিন্ন ভাষায় বলেন, চেকে জালিয়াতি হলেও চেক দুটি কিন্তু আসল। সংশ্লিষ্ট আলমারি ভেঙে চেকের মুড়িবই জব্দ করা হয়। এতে ওই দুটি চেকের মুড়ি নেই। অথচ ওই চেক বইয়ের ১০০টি পাতা ছিল বলে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা কাদির মিয়া প্রত্যয়ন করেছেন।
অন্যদিকে, লেজার বইয়ে চেক নম্বর, তারিখ লেখা থাকলেও পরে তা কালো কালি দিয়ে মুছে দেয়া হয়েছে। চেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর, অ্যাডভাইস, চেকের মুড়ি, লেজার বইসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই কি বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিপুল পরিমাণ টাকা ছাড় করেছে? যা এখনও ডাচ-বাংলা ব্যাংকের প্রধান শাখায় জমা রয়েছে।
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ডুমনী শাখা ম্যানেজার চেক পরীক্ষার জন্য না পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা ছাড় করলে ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকার দায়িত্ব কে নিত? এ দায় কি শুধু অফিস সহকারী আবু বকরের? ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ডিসি পর্যন্ত কারও কি কোনো দায় নেই? তাহলে কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এত টাকা ছাড় করল? না কি সেখানেও এ চক্রের কেউ রয়েছেন।
কেনই বা এলএ শাখাসহ ডিসি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে একজন জুনিয়র কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানো হল। কেনই বা এত তাড়াহুড়ো করা হল? ঘটনার পরপরই কেন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তাকে কেন পাঁচ মাসের প্রশিক্ষণে পাঠানো হচ্ছে? এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নাকি ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে কেন সংশ্লিষ্ট শাখার আলমারি ভাঙা হল।
এ প্রসঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবদুল কাদির মিয়া বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে। তদন্তের পর দোষী ব্যক্তিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা হিসেবে আপনার ওপর দায় বর্তায় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কাদির বলেন, আমাদের ওপর দায় আসবে কেন? আমরা তো জাল চেক ধরে টাকা ছাড় না করতে ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছি। এ কারণে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা রক্ষা পেয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা যা বললেন : আলমারি ভাঙার আগেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন স্বীকার করে তদন্ত কর্মকর্তা রুনা লায়লা বৃহস্পতিবার বলেন, আমাকে মাত্র দু’দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। আগ্নেয়াস্ত্র শাখার কাজ বন্ধ রেখে আমাকে প্রতিবেদন দিতে হয়েছে। এছাড়া অফিস সহকারী আবু বকর নিরুদ্দেশ থাকায় সব সন্দেহ তার ওপরেই পড়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। তিনি না থাকায় চেক বইয়ের মুড়ি, অ্যাডভাইস বা লেজার বুকের কোনো তথ্য আমি পাইনি। ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, অডিটরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেই প্রতিবেদন দিয়েছি।
প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর কেন আলমারি ভাঙা হল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন। একজন অফিস সহকারী এত বড় জালিয়াতি করতে পারেন বলে আপনি বিশ্বাস করেন কি না- এর জবাবে তিনি বলেন, দেখুন, আবু বকর নিরুদ্দেশ থাকায় তার বক্তব্য নেয়ার সুযোগ হয়নি। তার বক্তব্য পাওয়া গেলে বলা যেত আসলে এর সঙ্গে কারা জড়িত।
ডিসি যা বললেন : চেক জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে ঢাকার ডিসি আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান ১৪ জানুয়ারি নিজ দফতরে কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকার ডিডিএলজি মঞ্জুরুল হাফিজ ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) তানভীর আহমেদ।
এ বিষয়ে ডিসি ফেরদৌস খান বলেন, চেক জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত হয়েছে। এর সুপারিশের আলোকে একজন অফিস সহকারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য বিষয়টি দুদকে পাঠানো হয়েছে।
এলএ শাখার ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর দায় এড়াতে পারেন কি না এবং জুনিয়র কর্মকর্তা দিয়ে কেন সিনিয়র কর্মকর্তার সংশ্লিষ্ট বিষয় তদন্ত করানো হল- এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, চেক এবং এ সংক্রান্ত নথির পুরোটাই জাল বলে জানিয়েছেন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা কাদির। কাদির অপরাধী হলে দুদকের তদন্তে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে।
আর জুনিয়র কর্মকর্তা দিয়ে সিনিয়র কর্মকর্তার বিষয় তদন্ত করানো যাবে না, এটা কোনো আইনে আছে কি না- প্রতিবেদকের কাছে উল্টো জানতে চেয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তি যেই হোক তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছেন ডিসি, এটাই বড় কথা।
ডিসি আরও বলেন, অ্যাডভাইসসহ পুরো প্রক্রিয়াটিই জাল। এসব বিষয় নিশ্চয় দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আমরা চাই, এত বড় জালিয়াতির ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তারা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।
সৌজন্যে- যুগান্তর