সৌদি আরবে নারী অধিকার কতটুকুতে সীমাবদ্ধ সেটা আবারও নতুন করে সামনে এসেছে একটি নাটকীয় গল্পের মাধ্যমে। রাহাফ মোহাম্মাদ আল কুনুন নামের ১৮ বছর বয়সী তরুণী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি আবারও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। টুইট করেই বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে ইতিমধ্যে কানাডায় আশ্রয় পেয়েছেন ওই তরুণী।
কুনুনের ঘটনায় যখন সৌদি আরবের নারী অধিকার নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে তখন আরেক সৌদি তরুণীর দেশ পালানোর গল্প উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে। সৌদি আরব থেকে পালিয়ে স্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাস করছেন সালওয়া নামের ২৪ বছরের ওই তরুণীও। ৮ মাস আগে সালওয়া তার ১৯ বছর বয়সী ছোটবোনকে নিয়ে নাটকীয়ভাবে সৌদি আরব থেকে পালিয়ে কানাডার মন্ট্রিলে বসবাস করছেন। কীভাবে পাসপোর্ট, ভিসা, অর্থ যোগাড় করে বোনকে নিয়ে পালিয়েছিলেন সেটি তার ভাষায় বর্ণনা করেছে বিবিসি।
৬ বছর আগে বোনকে নিয়ে সৌদি আরব পালানোর পরিকল্পনা করছিলেন সালওয়া। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ছিল পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড)। সৌদি আরবে নারীদের কোনো কাজ করার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। সে কারণে দেশত্যাগ করতে হলে বাবা-মায়ের আইডি কার্ড প্রয়োজন ছিল তাদের। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সালওয়া বেশ ভাগ্যবতী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় তার বাবা-মা তাকে একটি আইডি কার্ড দেন। দুই বছর আগে ইংরেজি ভাষার ওপর পরীক্ষা দিয়েছিলেন সালওয়া। সে কারণে তার পাসপোর্টও করতে হয়েছিল। পাসপোর্ট ছিল তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া সঙ্গী ছোট বোনেরও। কিন্তু তার পরিবার সেই পাসপোর্ট তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। তখন কীভাবে পাসপোর্টটি আবার ফিরে পাওয়া যায় সেই চিন্তা করতে লাগলেন সালওয়া।
কেড়ে নেয়া পাসপোর্ট আবার কীভাবে হাতে পেয়েছিলেন সালওয়া? সেটিরও বর্ণনা করেছেন তিনি। তার ভাইয়ের কাছেই ছিল সেসব। একদিন ভাইয়ের ঘরের দরজার চাবি চুরি করেই পাসপোর্টটি হাতে পেয়েছিলেন তিনি। এরপর বাবা-মায়ের পরিচয়পত্রের ফটোকপি তৈরি করতে বাসার বাইরে যেতে হয়েছিল তার। অনুমতির প্রয়োজন হওয়ায় সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় তখন চুরি করে বাইরে যান তিনি। কিন্তু বাসার বাইরে যাওয়া দেখে ফেললে কী পরিণতি হতে পারতো? সালওয়া বলেছেন, যদি তারা জানতে পারতেন তাহলে আমাকে নির্যাতন করা হতো।
কিন্তু দেশের বাইরে যাওয়ার জন্যও তো পরিবারের অনুমতি প্রয়োজন। সে জন্য আর কী কী করতে হয়েছিল সালওয়ার? তার বর্ণনাও এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে।
একদিন তার বাবা যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন সালওয়া তার বাবার মোবাইলটি নিয়ে নেন। এরপর বাবার একাউন্ট ব্যবহার করেই সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন সালওয়া। এরপর বাবার মোবাইল নাম্বরের পরিবর্তে রেজিস্টার নাম্বর হিসেবে নিজের মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করেন। একই সাথে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বাবার একাউন্ট থেকেই তাদের দুই বোনের দেশ ত্যাগের ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছিলেন তিনি। যাতে করে মন্ত্রণালয়ের কাছে মনে হয়, তার বাবা মেয়েদের দেশ ত্যাগে অনুমতি দিয়েছেন।
এরপর সুযোগ বুঝে রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে যান তখন ছোট বোনকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান সালওয়া। তার ভাষায়, এটা ছিল অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ কেউ যদি এটা দেখে ফেলতো তাহলে সম্ভবত আমাদেরকে হত্যা করা হতো।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তারা যেহেতু গাড়ি চালাতে পারতেন না সেকারণে একটি ট্যাক্সি নিয়ে নিলেন। সৌদি আরবে বেশিরভাগ ট্যাক্সি চালক অন্যদেশের হওয়ায় তাদের সাথে পুরুষ সঙ্গী না থাকলেও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। ট্যাক্সি নিয়ে তারা চলে গেলেন কিং খালিদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। কিন্তু বিমানের টিকিট কাটা, ট্যাক্সি ভাড়া এসবের অর্থ কীভাবে পেয়েছিলেন সালওয়া?
শিক্ষা জীবনের শেষের দিকে একটি হাসপাতালে কাজ করেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই বিমানের টিকিটি এবং জার্মানির ট্রানজিট ভিসার জন্য অনেক টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন। এছাড়া বেকার ভাতার টাকাও জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। বিমানবন্দরে গিয়ে তারা কোনো বাধা ছাড়াই জার্মানির উদ্দেশে বিমানে উঠতে সক্ষম হলেন। এটাই ছিল তাদের জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণ।
এভাবে পালিয়ে যাওয়া ওই ভ্রমণ কেমন ছিল তাদের কাছে? সালওয়ার ভাষায়-এটা সত্যিই বিস্ময়কর ছিল। আমি অনেক খুশি ছিলাম। একইসঙ্গে অনেক ভীতও ছিলাম। আসলে আমি সে সময় সবকিছুই অনুভব করছিলাম।
তার বাবা যখন তাদেরকে বাসায় না দেখে পুলিশকে কল দিলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করেন সালওয়া। কারণ তিনি যে ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার বাবার একাউন্টটে প্রবেশ করে তার মোবাইল নাম্বর দিয়েছিলেন সেটি তার বাবা বুঝতে পারেননি। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। যখন কর্তৃপক্ষ তার বাবাকে কল দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। তখন কার্যত তারা সালওয়াকেই কল দিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত নাটকীয়ভাবে কেনো তাকে দেশ ত্যাগ করতে হলো?
সালওয়া মনে করেন, আসলে সৌদি আরবে তার স্বাভাবিক জীবন ছিল না। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া এবং বাসায় ফিরে আসার বাইরে তার কিছুই করার ছিল না। তার পরিবার তাকে নির্যাতন করতো, পুরুষরাই সবকিছুতে বাজে কথা বলতেন। এছাড়া তাকে ইবাদাত ও রোজা পালনের জন্যও জোর করা হতো। কিন্তু জার্মানি পৌঁছে তিনি কী করেছিলেন?
সালওয়া তার ছোট বোনকে নিয়ে জার্মানি পৌঁছিয়েই আশ্রয়ের জন্য আইনি প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়েছিলেন আইনজীবীর খোঁজে। সেখানে গিয়ে তিনি অনেকগুলো ফর্ম পূরণ করলেন এবং তার পালিয়ে আসার গল্প জানালেন। কিন্তু কানাডায় আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত তিনি কেনো নিলেন?
সালওয়ার সিরিয়ার অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে কানাডার সংবাদগুলো জানা ছিল। সেগুলো পড়ে তিনি মনে করতেন কানাডার মানবাধিকার সুরক্ষায় ভালো সুনাম আছে। আর সে কারণেই তিনি কানাডায় আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কানাডায় আশ্রয় চেয়ে তার দাবি পূরণ হয়েছিল। কানাডায় পৌঁছে যখন তিনি সে দেশের পতাকা দেখলেন তখন অনেক বড় কিছু একটা অর্জন করতে পেরেছেন বলে মনে হয়েছিল তার।
তখন থেকেই পালিয়ে আসার সঙ্গী ছোট বোনকে নিয়ে মন্ট্রিলে বসবাস করছেন সালওয়া। এখন তার কোনো কিছুতেই চাপ নেই। কেউ তাকে কিছু করার জন্য জোর করতে পারে না। সালওয়া মনে করেন, হয়তো সৌদি আরবে তার অনেক অর্থ থাকতে পারতো। কিন্তু তার স্বাধীনতা ছিল না। এখানে সে যখন ইচ্ছা বাইরে যেতে পারে। যখন ইচ্ছা আসতে পারে। আর এখন এসবের জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। তার ভাষায়-এখানে আমি অনেক অনেক ভালো অনুভব করি। আমি নিজেকে অনেক মুক্ত মনে করি। আমি এখন যা ইচ্ছা পরিধান করতে পারি। আমি ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখছি, বাইসাইকেল চালানো শিখছি, সাঁতার কাটা শিখছি এবং বরফের ওপর চলাচলের জন্য আইস স্কেটিংও শিখছি। আমি সত্যিই জীবনের সঠিক কাজগুলোই করছি। কিন্তু তার পরিবারের জন্য কী তার খারাপ লাগা কাজ করে না?
সালওয়া তার পরিবারের সাথে আর কোনোদিন যোগাযোগ করেননি। তিনি মনে করেন যোগাযোগ না করাটা তার এবং পরিবারের জন্যই ভালো। কারণ মন্ট্রিল এখন তার বাড়ি। আর এখানেই তিনি অনেক বেশি ভালো আছেন।
বিবিসি অবলম্বনে আল আমিন হুসাইন