বিশ্ব রাজনীতিতে ২০১৮ সালটি ছিল একটি ঝড়ো সময়। এ সময়ে তোলপাড় করার মতো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রকম চুক্তি বাতিল করা, বাণিজ্যিক লড়াই, কূটনৈতিক দর কষাকষি, সাংবিধানিক সংকট। এ বছরেই নিজের ক্ষমতা আরো পোক্ত করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। অন্যদিকে ২০২১ সালে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল। এ বছরেই অস্ট্রেলিয়ায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন স্কট মরিসন। উত্থান ঘটেছে ব্রাজিলে ডানপন্থি নেতা বলসোরানোর। এ বছরেই চির বৈরী উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই নেতার মধ্যে সিঙ্গাপুরে হয়েছে ঐতিহাসিক সামিট।
বৈঠক করেছেন দুই কোরিয়ার নেতা। যৌনতা বিরোধী আন্দোলন মি-টু ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এতে কুপোকাত হয়েছেন বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাতিল করেছেন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি। এ বছরেই হত্যা করা হয়েছে সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে। সর্বশেষ ইন্দোনেশিয়ায় আঘাত হেনেছে প্রাণঘাতী সুনামি। আর ব্রেক্সিট ইস্যুতে পুরোটা বছর কন্টকময় পথে হেঁটেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। এ সময়ে তার মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন সহ প্রথম সারির গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। ব্রেক্সিট ইস্যুতে তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অনাস্থা ভোট। তাতে উৎরে গেছেন তেরেসা মে।
শি জিনপিং আজীবন প্রেসিডেন্ট
২০১৮ সালের মার্চে পার্লামেন্টের শতভাগ ভোট পেয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন শি জিনপিং। ৬৪ বছর বয়সী এ নেতা ২০১৩ সালে পাঁচ বছর মেয়াদে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় পার্লামেন্ট সদস্যরা অনির্দিষ্টকালের জন্য তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাখার পক্ষে ভোট দেন। এতে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পান শি জিনপিং।
চতুর্থ দফায় প্রেসিডেন্ট পুতিন
বিরোধীদের দমনপীড়নের মাধ্যমে চতুর্থ দফায় নিজের ক্ষমতা ধরে রেখেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই বছরের মার্চের নির্বাচনে ছয় বছরের জন্য তিনি আবারো ক্ষমতায় আসেন। অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি রাশিয়া শাসন করবেন। গত দুই দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা পুতিন, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য দেশের সংবিধানে অবশ্যই পরিবর্তন আনবেন বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন পুতিন। তবে ওই নির্বাচনকে পাতানো বলে আখ্যা দেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। এসব সমালোচনার মধ্যেও ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে নিজের অবস্থান অনেকটাই দৃঢ় করতে সক্ষম হন এই নেতা।
ট্রামপ-কিমের ঐতিহাসিক করমর্দন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপ এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিং জং উনের মধ্যকার উত্তপ্ত সমপর্ক নিয়ে বিশ্ববাসী অবগত। পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি থেকে শুরু করে পরসপরকে ব্যক্তিগত আক্রমণও করতেন তারা। সমপর্কে এই তিক্ততা থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে ঐতিহাসিক সম্মেলনে সাক্ষাৎ করেন এই দুই নেতা। সেটাই ছিল তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। সে সময় তাদের করমর্দন বিশ্বব্যাপী আলোচনার ইস্যু হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যকার ওই বৈঠক সফলভাবে আনুষ্ঠিত করার পেছনে কাজ করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন। কোরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ট্রামপ ও কিম। এর পরিবর্তে উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার বিষয়ে সহমত প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও সম্মেলনে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করবে বলেও ঘোষণা আসে। এর মধ্য দিয়ে দুই কোরিয়ার মধ্যকার চলমান ৭০ বছরের পারসপারিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে।
ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি মে মাসে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপ। ২০১৫ সালের ওই চুক্তিতে নিজেদের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ করার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ইরান। ২০১৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রামপ চুক্তিটিকে বিপর্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ক্ষমতায় এলে তিনি এই চুক্তি বাতিল করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন সে সময়। এরই সূত্র ধরে এ বছর তিনি বলেন, ইরান যদি মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দেয় এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আকাঙ্ক্ষা অব্যাহত রাখে, তাহলে আগের থেকেও বেশি মূল্য দিতে হবে দেশটিকে। এ ছাড়াও ইরানের ওপর পুনরায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে দুই দেশের মধ্যকার সমপর্কে চিড় ধরে।
ব্রেক্সিট ইস্যু
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র থেকে বৃটেনকে প্রত্যাহারের চুক্তিটিই ব্রেক্সিট চুক্তি। ১৪ই নভেম্বর বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ও তার মন্ত্রিপরিষদ এই চুক্তিটি অনুমোদন দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ ১৯ মাস কড়া দরকষাকষির পর তেরেসা মে’র এই চুক্তিটি আলোর মুখ দেখে। তবে এ নিয়ে নিজ দেশের কিছু সংখ্যক নেতার কাছে তেরেসা মে সমালোচিত হন। এমনকি ক্ষমতা হারাতেও বসেছিলেন তিনি। তবে আস্থা ভোটে অল্পের জন্য বেঁচে যান। সব ঠিক থাকলে নতুন বছরের ১৯শে মার্চ ব্রেক্সিট চুক্তিটি কার্যকর হতে পারে।
ফ্রান্সের ইয়োলো ভেস্ট আন্দোলন
ফ্রান্সের ইয়োলো ভেস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত হয় জ্বালানি শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিবাদে। এই আন্দোলনের জের ধরে পরবর্তীতে আন্দোলনকারীরা দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। শুরুতে আন্দোলনকারীরা শুধু শনিবারে এ আন্দোলন করতেন। কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এ আন্দোলনে প্যারিস এবং প্যারিসের বাইরে বেশ কয়েকজন নিহত এবং কমপক্ষে ৩০০ জন আহত হন। শুধু প্যারিসেই ৪০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তীব্র এ আন্দোলনের মুখে হার মানেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোন। তিনি জ্বালানি শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেন। ফ্রান্সের স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য জরুরিভিত্তিক একটি সহযোগিতামূলক প্যাকেজের অনুমোদন দেন তিনি।
জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড
২রা অক্টোবর তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে ঘটে মর্মান্তিক এবং বিশ্বব্যাপী সামালচিত ও নিন্দিত হত্যাকাণ্ড। সৌদি আরবের সাংবাদিক, ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট এবং সৌদি সরকারের সমালোচক জামাল খাসোগিকে সৌদি কনস্যুলেট ভবনের মধ্যেই মর্মান্তিকভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যার পেছনে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় তুরস্কের পক্ষ থেকে। অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায় সিআইএ-এর তদন্ত প্রতিবেদনে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয় সৌদি রাজ পরিবার। সরব ছিল সারা বিশ্বের মিডিয়াগুলো। তবে আন্তর্জাতিক মহলের অভিযোগ থাকলেও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে খাসোগি হত্যায় ক্রাউন প্রিন্সের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। এদিকে খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটতে দেখা যায় সৌদি আরবের মিত্র যুক্তরাষ্টকে। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছে এমন ১৭ সৌদি নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেই অনেকটা দায় সারে ট্রামপ প্রশাসন। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে সৌদি আরব তার দেশের কয়েকজন ব্যক্তিকে আটক করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করছে।
শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট
অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। এরপর মাহিন্দ রাজাপাকসেকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। এদিকে বিক্রমাসিংহ তার পদ থেকে সরে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এতে করে দেশটিতে চরম রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। তবে শ্রীলঙ্কার আদালত এবং পার্লামেন্ট সিরিসেনার ওই সিদ্ধান্তকে বেআইনি বলার পর বিক্রমাসিংহকে অপসারণের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী পদে বিক্রমাসিংহকে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা এবং এরপর আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।
ইন্দোনেশিয়ার প্রাণঘাতী সুনামি
সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকমেপ কমপক্ষে ১২০০ জনের মৃত্যু হয়। সে সময় সমুদ্রের ২০ ফুট উঁচু ঢেউয়ে বিজ্ঞানীরাও বিস্মিত হয়েছিলেন। এরপরও ২৩শে ডিসেম্বর আরেক দফা ভূমিকম্প হয়। এতে কয়েক শত মানুষের মৃত্যু হয়। অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।
কিউবার সংবিধান পরিবর্তন
শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রেখে নতুন একটি সংবিধানের সংশোধিত খসড়া অনুমোদন করেছে কিউবার পার্লামেন্ট। সর্বসম্মতিক্রমে এটি পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়। সোভিয়েত আমলে প্রণয়ন করা কিউবার আগের সংবিধান পরিবর্তন করে নতুন সংবিধানে ব্যক্তিগত সমপত্তির বৈধতা দিয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে দেশটিতে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছে উচ্চগতি সমপন্ন মোবাইল ইন্টারনেট।
এ বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত প্রথম খসড়ায় লক্ষ্য হিসেবে ‘সাম্যবাদের পথে যাত্রা’ অংশ বাদ দেয়া হলেও সংশোধিত খসড়ায় সংবিধানের এ অনুচ্ছেদটুকু রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কিউবার এ পরিবর্তন আসলে সত্যিকারের কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই করা হচ্ছে। সূত্রঃ মানবজমিন।