দেশের বাহিরে বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন আমাদের অনেকেই থাকে। কিন্তু সঠিক তথ্য ও পরিকল্পনার অভাবে তা হয়ে উঠে না। দুনিয়া জুড়ে অসংখ্য বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সম্মানজনক বৃত্তি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রদত্ত ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ।
ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ মূলত মাস্টার্স এবং পিএইচডি পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইইউ এবং বিশ্বের অনন্য দেশের মধ্যে বৃত্তি ও একাডেমিক সহযোগিতা করে উচ্চশিক্ষায় মান উন্নয়ন করে।
ইউরোপাস মুন্ডাস স্কলারশিপগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের থেকে অর্থায়ন করা হয়। বিশেষ করে মাস্টার্স এবং ডক্টরেট পর্যায়ে ইরাসমাস মুন্ডাস যৌথ প্রোগ্রামগুলিতে অংশ নেয়ার জন্য, নির্বাচিত ইইউ এবং নন ইইউ উভয় দেশের শিক্ষার্থীদের তা প্রদান করে। (নন ইইউ ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি ইইউ ছাত্র/ছাত্রীদের চেয়ে বেশী হয়)।
ইউরোপে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রথম পছন্দ ইউরোপিয় ইউনিয়ন প্রদত্ত এ স্কলারশিপটি। ১৯৮৭ সালে শুরু হয়ে বিগত ৩০ বছরে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং সম্মানজনক বৃত্তি হিসেবে বিবেচ্য হয়ে আসছে এটি।
উচ্চতর গবেষণা, নতুন নতুন দেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পাশাপাশি এই স্কলারশিপের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে- মাসিক স্কলারশিপের পরিমাণ, সম্পূর্ণ ভ্রমণ ভাতা, স্বাস্থ্যবীমা ও গবেষণা সম্পর্কিত সকল খরচ বহন করে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি থেকে শুরু করে সব ধরনের টিউশন ফি, লাইব্রেরি ফি, পরিক্ষা ফি, গবেষণা সংক্রান্ত ফি সহ বিভিন্ন ধরনের কনফারেন্স/সেমিনার/ সামার স্কুল/উইন্টার স্কুল প্রভৃতি সকল কিছুই থাকে বিনামূল্যে।
একসময় শুধুমাত্র মাস্টার্স করার সুযোগ থাকলেও বর্তমানে ব্যাচেলর ও পিএইচডি জন্যও রয়েছে দারুণ সব সুযোগ। মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে একাধিক দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি থাকায় এ স্কলারশিপের অধীনে শিক্ষার্থী তার কোর্স চলাকালে নূন্যতম দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন।
তিন’শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৮৫ টি প্রোগ্রামে ২০ হাজারের কাছাকাছি শিক্ষার্থী ও ১৫০০ জনের মতো পিএইচডি শিক্ষার্থী প্রতি বছর ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। উন্নয়নশীল দেশ তথা- বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। ৬ মাস, ১০ মাস, এক বছর/দুই বছরের কোর্স কিংবা পিএইচডি ডিগ্রিতে বৃত্তি নিয়ে প্রতি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আসছেন বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী।
২০১৭-২০১৮ সেশনে ইরাসমাস প্লাস প্রকল্পের অধিনে, একশন-১ এ ৬১ টি স্কলারশিপ পেয়ে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে স্কলারশিপ প্রাপ্তির দিক থেকে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে; একশন-২ ও একশন-৩ মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট স্কলারশিপ প্রাপ্তির সংখ্যা ৮৯ টির মত।
নন ইউরোপীয় শিক্ষার্থী হিসাবে ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ আবেদনের প্রাথমিক তিনটি শর্ত হলো।
১/ আপনি ইইউ ভুক্ত ২৭ সদস্য দেশ এবং যুক্তরাজ্য, আইসল্যান্ড, নরওয়ে বা লিচেনস্টাইনের একজন বাসিন্দা নন।
২/ ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্য রাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য, আইসল্যান্ড, নরওয়ে বা লিচেনস্টাইনের মধ্যে আপনি গত পাঁচ বছরে মোট ১২ মাসেরও বেশি সময় ধরে আপনার প্রধান কার্যকলাপ (গবেষণা, কাজ, ব্যক্তিগত দর্শন, পর্যটন ইত্যাদি) সম্পন্ন করেননি।
৩/ আপনি ৩ বারের বেশি ইরাসমাস মুন্ডাস মাস্টার বা পিএইচডিতে আবেদন করেন নি।
মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনের ক্ষেত্রে সর্বশেষ ডিগ্রি সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট, জীবনবৃত্তান্ত, ইংরেজি ভাষাশিক্ষার স্কোর, শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত পড়ালেখা সম্পর্কিত মোটিভেশন লেটার ও শিক্ষার্থী সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখেন এমন দুজন যোগ্য ব্যক্তির সুপারিশপত্র (রিকমেন্ডেশন লেটার) দিয়ে আবেদন করতে হবে।
দেশি বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত শিক্ষার্থীর গবেষণাপত্র (যদি থাকে), যে প্রোগ্রামে পড়ালেখা করতে আগ্রহী সে প্রোগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা কিংবা তদসংশ্লিষ্ট সব ধরনের কাগজপত্র আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।
পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজস্ব প্রস্তাবিত গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়।
মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ তিনটি প্রোগ্রামে আবেদন করতে পারবেন। নির্দিষ্ট শিক্ষা বর্ষের জন্য অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস পর্যন্ত আবেদন প্রক্রিয়া চালু থাকে।
গতানুগতিকভাবে আবেদন না করে নিজের পড়ালেখা, গবেষণা অভিজ্ঞতা ও গবেষণা আগ্রহের সঙ্গে মিল রেখে বিষয়গুলো খুঁজে, আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আবেদন করা উচিত। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার স্কোর (আয়েল্টস/ টোফেল/জিআরই) গুরুত্বপূর্ণ তাই আবেদন পূর্বে অবশ্যই ভাল একটি স্কোর তুলতে হবে।
কিছু কিছু প্রোগ্রামে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার স্কোর জমা না দিয়েও আবেদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যদি তার স্নাতক পড়ালেখা সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যমে করে থাকেন, অর্থাৎ মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন যদি ইংরেজি হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি সনদ সংগ্রহ করে জমা দিতে হবে। আবেদন করার আগে নিজের পছন্দসই প্রোগ্রামের ওয়েবসাইট হতে কিংবা প্রোগ্রাম কো-অরডিনেটরকে মেইল করে, নিশ্চিত হওয়া যাবে এ প্রোগ্রামে মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন সনদ দিয়ে আবেদন করা যাবে কিনা।
মোটিভেশন লেটার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাই লেখার সময় যত্নবান হোন এবং সময় দিয়ে পরিকল্পিত ভাবে লিখুন। একজন শিক্ষার্থীকে তার নিজস্ব একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা, কেন তিনি এই প্রোগ্রামে আবেদন করেছেন সংক্ষিপ্ত কথায় তার আবেদনের তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, এই প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ কিংবা সমাজে কিভাবে উপকৃত হবে, নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রভৃতি নিখুঁতভাবে সুন্দর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে ১-২ পাতায় লিখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে ইন্টারনেট থেকে কিংবা ইতোপূর্বে উচ্চ শিক্ষায় দেশের বাহিরে আছেন এমন কারো সহযোগিতা নিতে পারেন।
ইরাসমাস স্কলারশিপের আবেদনের ক্ষেত্রে জীবন বৃত্তান্ত (Curriculum Vitae) জমা দিতে হয়। ইউরোপের জীবন বৃত্তান্ত তৈরিতে Europass ফরম্যাট ব্যবহার করা উত্তম। http:/europass.cedefop.europa.eu – এই লিংক থেকে Europass ফরম্যাটে সি ভি তৈরি করতে পারবেন। রিকমেন্ডেশন লেটার জমাদানের বাধ্যবাধকতা থাকে। শিক্ষার্থীকে ভালভাবে চিনে জানে এমন ২ জন ব্যক্তি থেকেই রিকমেন্ডেশন লেটার নিতে হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, স্নাতক/স্নাতকোত্তর গবেষণা কাজের সুপারভাইজার, কিংবা আপনার কর্মক্ষেত্র যদি আবেদনের সাথে সম্পর্কিত হয় তবে সেই প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে থেকেই রিকমেন্ডেশন লেটার নেয়া ভাল।
উল্লেখিত প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করে নিচের দেয়া লিংকে আবেদন করতে পারলে ইরাসমাস স্কলারশিপ পাওয়া সময়ের ব্যপার মাত্র এবং যেকেউ বাস্তবায়ন করতে পারে স্কলারশিপ নিয়ে ইউরোপে উচ্চ শিক্ষার কাঙ্খিত স্বপ্ন।
ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপের ওয়েবসাইট
ইরাসমাস মুন্ডাস মাস্টার্স কোর্সসমূহ
লেখক- মো. রাসেল আহম্মেদ, সৌজন্যে- যুগান্তর