Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

dhaka-central-jailদেশের ইতিহাসে ২০১৮ সালে কারাগারে বন্দীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি রয়েছে, যা কারাগারের স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতার প্রায় তিন গুণ। এর কারণ হিসেবে রাজনৈতিক পরস্পর আস্থাহীনতা ও বিরোধ সম্পর্ককে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের পরে কারাগারে বন্দীর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ জেলের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের কারাগারের মোট বন্দীর ধারণ ক্ষমতা ৩৬ হাজার ৬১৪ জন। অথচ ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত কারাগারে বন্দী রয়েছেন ৯৫ হাজার ৫০৫ জন মানুষ। অর্থাৎ ধারণ ক্ষমতার প্রায় তিন গুণ বন্দী রয়েছেন দেশের কারাগারে।

chardike-ad

তথ্য মতে, কারাগারে পুরুষ বন্দীর ধারণ ক্ষমতা ৩৪ হাজার ৯৪০ জনের। কিন্তু বর্তমানে সেখানে বিচারাধীন পুরুষ বন্দীই রয়েছেন ৭৩ হাজার ৩৩৩ জন ও সাজাপ্রাপ্ত ১৮ হাজার ৪৮৭ জন। অপরদিকে কারাগারে নারী বন্দীর ধারণ ক্ষমতা এক হাজার ৬১৪ জনের। আর বিচারাধীন নারী বন্দী র‍য়েছেন তিন হাজার ৩৩ জন ও সাজাপ্রাপ্ত ৬৫২ জন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সালে কত বন্দী ছিলঃ ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফ নামের একটি বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার ১৬৪ জন। ১৯৯৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৬১৮ জনে। আর পাঁচ বছর পরে ১৯৯৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫১ হাজার ৪৯৯ জনে। ২০০০ সালে সারা দেশের কারাগারে মোট বন্দীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ৬৬৯ জনে।

ওই প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৭১ হাজার ১১৪ জন। ২০০৮ সালে বন্দীর সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ হাজার ৮৩৮ জনে।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৮৮ হাজার ৪২৪ জন। আর চলতি বছরের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্দীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৫০৫ জন। অর্থাৎ তিন মাসে কারাগারে আরও বন্দী যুক্ত হয়েছেন সাত হাজার ৮১ জন।

বেড়েছে নারী বন্দীর সংখ্যাওঃ ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফের তথ্যানুযায়ী, পুরুষ বন্দীর পাশাপাশি নারী বন্দীদের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের কারাগারে নারী বন্দীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৯১০ জন। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩২৪ জনে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের তথ্য মতে, বাংলাদেশের কারাগারে নারী বন্দীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৯৯২ জন। তবে নারী বন্দীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম বৃদ্ধি পেয়েছে।

‘রাজনৈতিক পরস্পর আস্থাহীনতা ও বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বন্দীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ’: এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, ‘জনসাধারণের কাছে এটা একটা বড় চিন্তার বিষয় যে, কারাগারে পর্যায়ক্রমে বন্দীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর সাথে অনেকগুলো কারণ জড়িত। প্রথম কারণটি হলো, রাজনীতির মধ্যে যত বেশি পরস্পর আস্থাহীনতা, পরস্পর বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক এবং যত বেশি দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া জোরালো হচ্ছে, তত বেশি মামলা হচ্ছে। ঠিক সে কারণেই তত বেশি কারাগারে বন্দীর সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এই বিষয়টি বেশ লক্ষণীয়। আবার যখন কেউ কোনো অপরাধ করবে বা হামলা করবে, তখন অবশ্যই তার বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং তাকে কারাগারে বন্দী হিসেবে পাঠানো হবে।’

তিনি বলেন, ‘এই বন্দী বেড়ে যাওয়া দেখে স্বাভাবিকভাবে এটা মনে হয় যে, আমাদের দেশে অপরাধ এবং সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। তবে এটাও ঠিক যে বর্তমান সময়ে কমিউনিটি ক্রাইমের মামলার চেয়ে রাজনৈতিক মামলার সংখ্যা বেশি। এর অবশ্য বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যাও রয়েছে। একেক রাজনৈতিক দল একেকভাবে সেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকেন। সেটি কিন্তু ভিন্ন বিষয়।’

তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমরা যদি অপরাধ এবং সংশোধনের জায়গা থেকে বিচার করি, তাহলে আমরা দেখতে পাই জেলখানা হলো একটি সংশোধনের জায়গা। সেই সংশোধনটি তখনই হবে যখন বন্দীদেরকে সংশোধনের জন্য যে যে বিষয়গুলো দরকার, সেই বিষয়গুলোর ব্যবস্থা করে তাকে রাখতে পারবে। এখন যেখানে ধারণ ক্ষমতা ৩৬ হাজার, সেখানে আছে প্রায় এক লাখের মতো। তাহলে বোঝা যায় যে, ৩৬ হাজার বন্দীর জন্য যে ব্যবস্থা, সেটাই ব্যবহার করছে প্রায় এক লাখ বন্দী। সে কারণে আসলে সেখানে সংশোধনের কোনো সুযোগই তৈরি হয় না।’

রাজনৈতিক আচরণের বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘কোনো একটি দল ক্ষমতায় থাকার জন্য বিভিন্নভাবে যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করে, সেগুলো অপর একটি দল আদর্শগতভাবে হোক বা ক্ষমতার যাওয়ার জন্যই হোক, তারা এগুলো মানে না। তখন তারা সহিংস আন্দোলন করে বা হামলা-ভাঙচুর করে, জনগণের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ধরনের আচরণ করে। সরকার এই আচরণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন থানায় মামলা গ্রহণ করে তাদের জেলে রাখে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্যে। তবে এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা কোনো প্রক্রিয়া কি না, সেটাই আসলে আলোচনার বিষয়। আর সেটা কতটা গ্রহণযোগ্যভাবে হয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাংবিধানিকভাবে যেখানে আমরা বসবাস করি, সেখানে যদি এইভাবে বন্দী দিয়ে জেলখানাকে সাজানো হয়, তাহলে আমরা আগামীর জন্য খুব ভালো একটি স্বপ্ন দেখতে পারি না।’

কারাগারকে পুরোপুরি সংশোধনাগার হিসেবে তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দেখা যায় একজন আসামি আদালতের মাধ্যমে এখনো কোনো সাজাপ্রাপ্ত হয় নাই। অর্থাৎ অপরাধ এখনো প্রমাণিত হয় নাই, কিন্তু সে দীর্ঘদিন থেকে জেলে আছে। এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় বেদনাদায়ক। কিন্তু রাষ্ট্র সেটাকে কতটুকু উপলব্ধি করবে সেটা ভিন্ন বিষয়। তাকে বিচারবহির্ভূতভাবে বছরের পর বছর জেলে বন্দী রাখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে অন্য ধরনের উন্মুক্ত কারগার আছে, যেখানে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এটা নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছার ওপরে যে, তারা কতটা ভালোভাবে জেলখানাকে সংশোধনাগার হিসেবে তৈরি করতে পারে। একই সাথে যারা মামলায় আদলত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটছেন, তারা যেন সাজা খেটে জেল থেকে একজন সংশোধিত ভালো নাগরিক হিসেবে বেরিয়ে আসেন, সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাজ।’

‘গায়েবি’ মামলা: সম্প্রতি সারা দেশে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ‘ভুতুড়ে’ বা ‘গায়েবি’ মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীসহ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত চার হাজার মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এসব মামলায় তিন লাখেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এ ধরনের মামলায় অনেককে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ।

এমন ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। গত ৮ অক্টোবর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করে।

এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর এ মামলাগুলোর বিষয়ে একটি তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ বিএনপিপন্থি তিন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

রিটে সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অগণিত মানুষের বিরুদ্ধে ‘কাল্পনিক’ মামলা করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, সে মর্মে রুল জারিরও আর্জি জানানো হয়।

রিটে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধি রাখার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া এসব মামলা দায়েরের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে রুল জারির আবেদনও জানানো হয়েছিল।

অপরদিকে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম দফা সংলাপে বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ‘গায়েবি’ মামলার তালিকা চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সেই তালিকা জমা দিয়েছে দলটি। ওই তালিকায় পাঁচ হাজারের অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১০৪৬টি ‘গায়েবি’ মামলার তালিকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি।

কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য: সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, ‘কারাগারে বন্দী বেড়ে যাবার কারণে আমাদের কিছুটা সমস্যা তো হচ্ছেই। এরপরও সবকিছু সামাল দিয়ে বন্দীদের রাখতে হচ্ছে।’

বন্দীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বন্দীর সংখ্যাটা আসলে বেড়ে গেছে তখন, যখন মাদকের অভিযানটি শুরু হলো। ঠিক তারপর থেকেই কারাগারে বন্দী বাড়তে শুরু করেছে। গড়ে আমাদের কারাগারে প্রায় ৭০ হাজার বন্দী থাকত। মাদকের অভিযান শুরু হবার পরে পর্যায়ক্রমে ৭৫ হাজার, ৮০ হাজার থেকে বেড়ে ৯০ হাজার অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ ২০ হাজারের মতো বেড়ে গেছে। আর এখন স্বাভাবিক বন্দী যেটা, সেটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

সৌজন্যে- প্রিয়.কম