ভেনিস নগরীর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কোথায় এ্যান্টোনিও, ব্যাসিনিও, পোর্শিয়া কিংবা ধুরন্ধর শাইলক! বিশ্ব সাহিত্যের এই অসাধারণ চরিত্র গুলো পেয়েছিলাম, শেক্সপীয়রের লেখা “মার্চেন্ট অব ভেনিস” পড়তে গিয়ে। তখনই সেই কোন কালের কথা! ভেনিস মনের মধ্যে গেঁথে গেলো। আর ভেরোনা শহরকে পেলাম, “রোমিও জুলিয়েটের” সান্নিধ্যে এসে। আর কত বছর হয়ে গেলো ক্লাশে স্টুডেন্টদের শেক্সপীয়র পড়াচ্ছি। আমার অতি প্রিয় একটি বিষয় হলো, চিরায়ত বিশ্ব সাহিত্য। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন নগরীর মধ্যে একটি হলো ভেনিস! রোম থেকে ট্রেনে চেপে ভেনিস আসতে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা লেগে গেলো। ক্লান্তিতে চোখে রাজ্যির ঘুম! পুরো জার্নিটা ঘুমেই কেটে গেলো। বাইরের দৃশ্য কিছুই দেখা হলো না। নিজের ওপর তো রাগ হলোই মেয়ে ও তার বাবার ওপরও রাগ কম হলো না। কেমন করে জানবো কেমন ছিলো বাইরের দৃশ্য!
এদিকে প্রাচীন রোমান সভ্যতা, ফরাসী বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সব কিছুই মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু সময়ের অভাবে মনের মতো করে এসব বিষয় লিখে উঠতে পারি নি। যাক এসব কথা! এগুলো অন্য লেখায় দেয়ার চেষ্টা করবো। ট্রেন থামলো এসে “ভেনেজিয়া মেস্ট্রে” স্টেশনে। আমরা তিনজন ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের অন্য পাশেই “বেস্ট ওয়েস্টার্ন প্লাস” হোটেলে এলাম। কোনোরকমে ফ্রেশ হয়েই বের হলাম। কারন উদর পূর্তি করেই, আবার পরের ট্রেনে যেতে হবে ভেনিস নগরীর সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হতে। আর যেনো দেরী সইছে না। আশে পাশে কোন বাঙালী রেস্টুরেন্ট না পেয়ে শেষ ভরসা ম্যাক’ ডোনাল্ডসেই যেতে হলো। যাক! আপাততঃ খিদেকে বিদায় দিয়ে স্টেশান থেকে টিকেট কেটে ভেনিস শহরটি যেখানে সেখানে গিয়ে নামলাম। যাওয়ার পথে দুধারে চমৎকার রাস্তা দেখতে দেখতে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি, ওহ মা! এতো রাস্তার দু’ধারে সাগরের স্রোত ধারা বয়ে যাচ্ছে। দূরে জাহাজের মাস্তুল লক্ষ্য করলাম, আরো দেখলাম এয়ারপোর্ট গামী বাস, ছোট ছোট গাড়িও ছুটছিলো অতি ব্যস্ততার সাথে। অবাক হয়ে দেখছি আর ভাবছি পৃথিবীটা কী অদ্ভূত ভাবে নিজের নিয়ম মতো চলছে। থেমে থাকার অবকাশ বুঝি কারো নেই। কিন্তু গন্তব্য চলে এসেছে, ট্রেন থামলো তাই সব যাত্রিদের সাথে আমরাও পা বাড়ালাম শহরটার মূল কেন্দ্র বিন্দুতে!
অসংখ্য পর্যটকের সাথে আমিও ভাবছিলাম এও কী সম্ভব! এমন একটা প্রাচীন শহরের মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে, ক্যানেল বা খালের মতো পানির ধারা! সিড়ির ওপর দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময় ভরা চোখে ওপারের পুরোনো বাড়ি ঘর, সরকারি দালান, হোটেল দেখায় ব্যস্ত আমার চোখ। কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো ভেনিস আর ভেরোনা শহরকে নিয়ে লেখা দুটো নাটকের চরিত্র গুলো। আমি মনের চোখ দিয়ে অনুভব করছিলাম তাদের। আজ কোন শহরের ইতিহাস লিখতে বসি নি। মন চাইছিলো শহর ঘুরে অনুভব করি কয়েক শো বছর আগে শেক্সপীয়রের এই চরিত্র গুলো কী ভাবে বিচরণ করেছিলো এখানে।
এই অল্প সময়ে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ ছ’টা ব্রিজ পার হলাম। পুরোনো ঢাকার অলি গলিতে যেনো ঘুরে বেড়াচ্ছি এমনই অনুভব হচ্ছিলো আমার! বাড়ি ঘর বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কত জড়াজীর্ণ! কাঠের বড় বড় দরজা জানালা আবার ঘুলঘুলিও কাঠের। এই সব দালানের ভেতরই সুসজ্জিত রেঁস্তোরায় সুমধুর গান বাজছে, কোন দোকানী ব্যাগ বিক্রি করছে, কেউ বা আবার বিভিন্ন রকমের স্যুভেনীর বিক্রিতে ব্যস্ত। পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত দোকান পাট। তিল ধারণের জায়গা মাত্র নেই। আহসান মঞ্জিল, ছোট কাটরা, বড় কাটরা আর ইসলামপুরের সাথে অনেকেই মিল খুঁজে পাবে ভেনিস নগরীর পুরোনো দালান কোঠার সাথে। কিন্তু বাইরে থেকে দালান কোঠা গুলো যতই পুরোনো মনে হোক না কেন ভেতরে কিন্তু একেবারে সংস্কার করে সব কিছুই পরিপাটি করে রাখা হয়েছে। এটা বোধহয় এদের বৈশিষ্ট্য। এরা প্রাচীন ঐতিহ্য কে একদম অবিকল সংস্কার করে ওই রকমই রেখে দেয়। ভেতরটা নিজেদের মতো করে সুসজ্জিত করে নেয়। তাই রোমের পুরোনো ভবন, দোকান, হোটেল বাইরে থেকে দেখে তার ভেতরটা বোঝার উপায় নেই। কেমন করে রোমানরা পেরেছে অবাক লাগে। যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। এ যেন এক আলাদা জগত। বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মাথা কাজ করছিলো না। মাথার দোষ দিয়েই বা কী লাভ! প্রাচীন এই ভেনিস নগরীর প্রত্যেকটা বিষয়ই আমার কাছে অভিনব ঠেকছিলো। এতো অল্প সময়ে বুঝে ওঠা আসলেই দুস্কর।
গলির ভেতর দিয়েই ক্যানেল বা খাল বয়ে চলেছে আপন মনে। যেন প্রাচীন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। ইতিহাসে দেখেছি বিভিন্ন যুগে রাজা বাদশাহ রা শত্রুর আক্রমন ঠেকাতে পরিখা তৈরি করে শহর কে আলাদা রাখতেন, এ শহর কেও বয়ে যাওয়া খাল তেমনিভাবে আলাদা করে রেখেছে বৈকি। ব্রিজ ছাড়া এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়া সম্ভব নয়। সবার মনেই বোধহয় এমন প্রশ্ন জেগে ওঠা অসম্ভব নয়। একটি বড় কালভার্টের ওপর দাঁড়িয়ে অদ্ভূত সুন্দর আকাশ দেখছিলাম। কন্যা ও তার বাবা ফটোগ্রাফি করায় ব্যস্ত। ‘আপা, কোন দেশ থেকে আইছেন!’ এই ডাকে চমক ভাঙলো। ওমা! এ দেখি আমাদের দেশের মানুষ এখানে ব্যবসা করে। যেই শুনলো আমার সাথের মানুষের কাছে তার বাড়ি নোয়াখালি, আর কী গল্প থামে! সেই ব্যবসায়ী সহ আরও কয়েকজনের বাড়িও নোয়াখালি।
ব্যাস নোয়াখালির ভাষায়, “আইন্নের বাড়ি কোনাই! আর বাড়ি বেগম গঞ্জ!” এই ভাবে চললো কিছুক্ষণ গল্প বাজি। মেয়েও একটা নীল টুপি কিনে কয়েকটা ছবি তুলে ফেললো। সামনের দিকে এগুতেই দেখি এক ইটালিয়ান রমনী কী চমৎকার নিখুঁত হাতে রঙ তুলি দিয়ে পটারি সহ বিভিন্ন সিরামিকের তৈজস পত্রের গায়ে এঁকে চলেছে। তার অতুলনীয় ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে একটা ছোট্ট দেয়ালে ঝুলানো সিরামিকের ফটো কিনলাম। আমায় একটা কার্ড দেয়ার সময় বললাম, “তোমার নাম লিখে দাও, আর স্মৃতি স্বরূপ তোমার সাথে ছবি তুলতে চাই,” (ইংরেজিতে বললাম) সে তখুনি হেসে আমার সাথে ছবি তুললো এবং তার ভাষায় আমাকে বিদায়ও জানালো। এ এক বিস্ময়কর অনুভূতি। দুই দেশের দুই ভাষাভাষীর মানুষ কে একমাত্র শিল্প কর্মই একীভূত করে ফেলতে পারে এক নিমিষে। আসলে শিল্প সাহিত্যের কী কোন সীমানা নির্ধারন করা থাকে! নাহ্, কোন বিভাজন থাকে না। সামনে বের হতেই দেখি একপাশে রাস্তা ঘাট সহ একটি শহর আর অন্য পাশে বয়ে যাওয়া খালের ধারা গিয়ে মিশেছে সাগরে! নাম তার Adriatic Sea! শহরের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা খালটি ক্রমান্বয়ে কে
সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি বাঙলা কলেজ, ঢাকা।