নিজ দেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, তেলের দরপতনের কারণে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা কারণে সংকুচিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার। এই বাজার সংকোচনের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা। কিন্তু মালয়েশিয়ায় বর্তমানে তেমন কোনও অর্থনৈতিক অস্থিরতা নেই। তারপরও সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের মতো শ্রমিকদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে নিজ দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্যোগ বিদেশি শ্রমিকদের জন্য বাজার সংকোচনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, ওমান, কাতার সব দেশেই শ্রমবাজারে চলছে মন্দাবস্থা। সৌদিআরবের নাগরিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সৌদিকরণ শুরু করেছে সেদেশের সরকার। এরই অংশ হিসেবে প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়োগকর্তার ওপর শ্রমিক প্রতি লেভি (এক ধরনের কর) আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি সরকার। যার ফলশ্রুতিতে প্রায় ৭ লাখ প্রবাসী শ্রমিক সৌদিআরব ছেড়ে চলে যায় বলে সৌদি সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয়। সৌদি সরকার এও বলেছে বিদেশি শ্রমিকদের জায়গায় যাতে স্থানীয়রা কাজের সুযোগ পায় সেই লক্ষ্যে এই করারোপ করা হয়েছে।
সৌদি সরকারের দেওয়া তথ্য মতে, সেদেশ ছেড়ে যাওয়া বেশিরভাগ বিদেশি শ্রমিক বিল্ডিং এবং স্থাপনা নির্মাণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং সিংহভাগই দক্ষিণ এশিয়ার। সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে সব কোম্পানি বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ করে তাদেরকে শ্রমিক প্রতি মাসিক ৩০০ সৌদি রিয়াল লেভি দিতে হবে এবং যারা স্থানীয় নাগরিকদের চেয়ে বিদেশি শ্রমিকের ওপর বেশি নির্ভরশীল তাদেরকে শ্রমিক প্রতি ৪০০ সৌদি রিয়াল লেভি দিতে হবে। সৌদি সরকার নির্ধারিত এই ফি বছর বছর বাড়বে বলেও জানান তারা। সৌদি বাদশা আবদুল্লাহ বিন সালমানের রূপকল্প অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে ১২ লাখ সৌদির কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথ ধরেই সৌদি সরকার বিদেশি শ্রমিকদের লেভি ঘোষণা করেছে। সৌদি আরবের আগেই প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে আবুধাবিতে বাড়ি ভাড়ার ওপর ৩ শতাংশ পৌর কর এবং দুবাইতে ৫ শতাংশ পৌর করের সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য, দালালচক্রের নানা অপতৎপরতা এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ায় ২০১২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করে দেয়। সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ছিল আমিরাতের শ্রমবাজার। তবে এই বছর নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে আমিরাত সরকার জানিয়েছে তারা ধাপে ধাপে এদেশে থেকে দক্ষ জনশক্তি নেবে।
২০১৩ সালের আরব আমিরাতের করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কাতারের ৯৫ শতাংশ, আরব আমিরাতের ৯৪ শতাংশ, কুয়েতের ৮৩ শতাংশ, ওমানের ৭১ শতাংশ, বাহরাইনের ৬৪ শতাংশ এবং সৌদি আরবের ৪৯ শতাংশ শ্রমিক বিদেশি। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) ভুক্ত দেশ সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন,এবং ওমান এখন তাদের শ্রমখাতের উল্লেখযোগ্য অংশ জাতীয়করণের দিকে ঝুঁকছে। নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্যই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এ পদক্ষেপ নিয়েছে ও নিতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডি ১০ অক্টোবর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের শ্রমবাজার জাতীয়করণের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাতে সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারলেও প্রাইভেট সেক্টরে প্রবাসী শ্রমিকদের অভিবাসন খরচ বাড়বে। এছাড়াও রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যদি কোনও কারণে এই জাতীয়করণের প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয় তাহলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়া সরকারও চাচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে এনে স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে। এজন্য প্রবাসী শ্রমিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রমিক প্রতি ১০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত লেভি দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। তবে যারা এই পরিমাণ অর্থ দিতে আগ্রহী নয় তাদের জন্য রয়েছে অন্য সুযোগ। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ান নিয়োগকর্তা তার একই শ্রমিককে পুনরায় নিয়োগ ( রি- হায়ারিং) করতে চাইলে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে এবং সেই শ্রমিক দেশে ফেরত যেতে পারবেন। কিন্তু ওই শ্রমিককে পুনর্নিয়োগের জন্যও দিতে হবে ১ হাজার ৮০০ রিঙ্গিত চার্জ।
মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগেরানি এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘‘ শ্রমিক পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি ‘কুলিং পিরিয়ড’ এর ব্যবস্থা করা হবে। নিয়োগ কর্তাদের ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে যদি তারা একই শ্রমিককে পুনরায় নিয়োগ দিতে চান। যখন নিয়োগ কর্তারা আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন যে, তাদের শ্রমিকদের বৈধতা আরও ১০ বছর বাড়াতে চান, তখন আমরা বলেছি আমরা অবশ্যই বাড়াবো কিন্ত এজন্য ১০ হাজার রিঙ্গিত ফি দিতে হবে এবং এটাই প্রক্রিয়া। তবে এখন তারা যেসব শ্রমিককে ফেরত পাঠাতে চাচ্ছেন তাতেও আমাদের কোনও সমস্যা নেই। তারা পাঠাতে পারেন। এসব শ্রমিককে নিয়োগ কর্তারা পুনরায় নিয়োগ দিতে চাইলে আবেদনপত্রের সঙ্গে ১ হাজার ৮০০ রিঙ্গিত পরিশোধ করতে হবে।’’
কুলাসেগেরান আরও জানান, নিয়োগ কর্তাদের ওপর পুরো ফি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যাতে তারা বিদেশি শ্রমিকের চেয়ে স্থানীয়দের নিয়োগে প্রাধান্য দেয়।
এদিকে সম্প্রতি মানবসম্পদবিষয়ক উপমন্ত্রী মাহফুজ উমর বলেছেন, বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিচ্ছে মালয়েশিয়ার সরকার। এ লক্ষ্যে কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ এবং পরিশ্রমী দেশীয় কর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে তারা। বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো মালয়েশিয়ার অনেক দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এ কারণেই আমরা খুব শীঘ্রই দেশীয় কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করবো।
তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মধ্যপ্রাচ্যের বাজার সংকুচিত হওয়ার কথা বললেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সংকুচিত হবে না বলে ধারণা করছে। পাশাপাশি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যে নিয়মতান্ত্রিক সংকট আছে সেগুলো দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারটিকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় আনায় বেশি জরুরি। কারণ, যেই সমস্যাগুলো আছে মালয়েশিয়ার বাজারে তাতে শুধু সংকুচিত হয়ে আসা নয়, দুর্নামটাও হবে আমাদের। মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার নিয়ে দুর্নীতি সেদেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও হচ্ছে। আগে যে পরিমাণ লোক মালয়েশিয়ায় যেত, বর্তমানে কিন্তু যাচ্ছে না। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় যেই পরিমাণ বৈধ শ্রমিক থাকে,ঠিক একই পরিমাণ অবৈধ লোক পাওয়া যায়। এই বিপুল পরিমাণ অবৈধ লোক থাকার ফলে যেটা হয় তা হলো ঐ অবৈধ লোকগুলোকে কাজে নেয় নিয়োগকর্তারা কম বেতনে। এজন্য আবার বৈধরা কাজের সুযোগ পায় না। সবসময় একটি অসামঞ্জস্য পরিস্থিতি বিরাজ করে। তাই আমাদের এই বাজারের সংকটগুলোকে একটি শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কাজ করতে হবে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক এবং অভিবাসন বিশ্লেষক ড. জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, মালয়েশিয়ার বাজার ছোট হয়ে আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ মালয়েশিয়ার অর্থনীতি ম্যানুফ্যাকচারিং এবং কৃষি খাতে নির্ভরশীল। ১৯৯৭ সালে তাদের যে অর্থনীতির মন্দা হয়েছিল যাকে বলা হয় এশিয়ান ইকোনমিক ক্রাইসিস। এতে মালয়েশিয়া , সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং এরা প্রতিকূল অবস্থায় খুব লড়াই করেছিল। তখন তাদের জনগণ টাকা পয়সা দিয়ে, স্বর্ণ বিক্রি করে এর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। মালয়েশিয়া ম্যানুফেকচারিং সাইডকে বাদ দিয়ে কৃষি খাতে প্রচুর বিনিয়োগের কারণে এরকম ক্রাইসিসে পড়েছিল।
ড. জালাল আরও বলেন, এখনও বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, তাই এই সময়ে ম্যানুফেকচারিং খাত থেকে তারা আবার কৃষি খাতে পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ার জন্য তাদের স্থানীয় জনগণ প্রস্তুত কিনা এটা একটা প্রশ্ন। সৌদি আরবে যেটা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে শরণার্থী এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে। যার কারণে তারা বলছে তাদের স্থানীয় লোকজনকে চাকরি দেবে। কিন্তু সৌদি সরকার প্রণোদনা দিয়েও অভিবাসী শ্রমিকের বিকল্প শ্রমিক পাচ্ছে না। যার কারণে সৌদিরা ইয়েমেনের শরণার্থী ও ইয়েমেন থেকে সুন্নিপন্থী যারা দেশটিতে ভিড় করছে তাদের দিয়ে কাজ করাতে চাচ্ছে। এই জিনিসটা কিন্তু আবার মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে সম্ভব না। মালয়েশিয়া যেটা করতে পারে তা হলো রোহিঙ্গাদের তারা নিতে পারে, যেহেতু প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদের একটি দুর্বলতা আছে। কিন্তু তার সংখ্যাই বা কতো? মালয়েশিয়ার যেই পরিমাণ শ্রমিক দরকার সেটা এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে আশাবাদের কথা ব্যক্ত করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি একটি প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়া থেকে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং করে এসেছে। সেই প্রতিনিধি দলের সদস্য এবং মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কর্মসংস্থান)ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ছোট হতে পারে, তবে মালয়েশিয়ার বাজার ছোট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমরা যখন মিটিং করেছি তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে তাদের শ্রমিক প্রয়োজন। মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এবং তাদের নিজস্ব জনশক্তির যে ঘাটতি আছে, তাতে আমাদের লোকদের তাদের দরকার হবে। তাই সেখানে হঠাৎ করে সংকুচিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।
সৌজন্যে- বাংলা ট্রিবিউন