মাত্র ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগের ছোট কারখানা থ্রি এস ইন্টারন্যাশনাল। মিরপুরের সোয়েটার কারখানাটি বায়িং হাউসের মাধ্যমে ক্রেতাদের রফতানি আদেশ সরবরাহ করত। তিন বছর আগে পরপর দুই দফায় দুই ক্রেতার রফতানি আদেশের সোয়েটার সময়মতো পৌঁছাতে না পেরে বিপদে পড়ে কর্তৃপক্ষ। উৎপাদনে সময় বেশি লেগে যাওয়ায় ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি রক্ষা করা যায়নি। চুক্তির নির্ধারিত সময়ে না পাওয়ায় পণ্য নিতে রাজি হয়নি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। শেষ পর্যন্ত স্টকলট হিসেবে স্থানীয় বাজারে এক রকম পানির দরে বিক্রি করে দিতে হয় মোট ৫০ হাজার পিস সোয়েটার। এই দুই স্টকলটেই পথে বসেছেন থ্রি এস ইন্টারন্যাশনালের মালিক সফিকুল ইসলাম। এদিকে ব্যাংক ঋণের খÿ। কারখানা সংস্কারের জন্য অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। নতুন করে অর্থ দিতে রাজি হয়নি কোনো ব্যাংক। ফলে এক বছর অচল থাকার পর এক পর্যায়ে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। বিজিএমইএ থেকে সদস্যপদ বাতিল করা এক হাজার ১৬৩ কারখানার তালিকায় প্রথম নামটিই হলো থ্রি এস ইন্টারন্যাশনাল।
থ্রি এস ইন্টারন্যাশনালের মতো গত ৪ বছর ধরে পোশাক খাতের চলমান সংস্কার চাপে উৎপাদন থেকে ছিটকে পড়েছে তিন সহস্রাধিক কারখানা। এসব কারখানা এখন উৎপাদনে নেই। অনেক কারখানাই বন্ধ। এর মধ্যে বিজিএমইএ থেকে বাদ পড়েছে মোট এক হাজার ১৬৩টি কারখানা। বিকেএমইএ থেকে বাদ পড়া এবং সংস্কার চালাতে রাজি না হওয়া- এ দুই কারণে ৮০০ কারখানা এখন আর উৎপাদনে নেই। পোশাক খাতের সংস্কার বিষয়ক ইউরোপের ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড থেকে বাদ পড়েছে ১৪৪টি। অপর ক্রেতাজোট উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্স থেকে বাদ পড়েছে ১৫৭টি কারখানা। অর্থাৎ সংস্কারে অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই জোট থেকে বাদ পড়েছে ৩১১টি কারখানা। দুই ক্রেতাজোটের বাইরে অন্য ক্রেতাদের রফতানি আদেশ সরবরাহ করা হয় এ রকম এক হাজার ৮২৭টি কারখানার সংস্কার চলছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) অধীনে।
ডিআইপি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক পরিদর্শনে বাদ পড়া এবং সংস্কারের ব্যয় জোগানে ব্যর্থতাসহ কিছু কারণে অনেক কারখানা এখন বন্ধ। ডিআইএফইর অধীনে কারখানা এখন মাত্র ৮০৯টি। অর্থাৎ ডিআইএফইর অধীন কারখানা বন্ধ হয়েছে এক হাজার ১৮টি। এই নিয়ে মোট তিন হাজার ২৯২টি কারখানা উৎপাদনে নেই। এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। সংস্কার চালিয়ে যেতে ব্যর্থতার দায়ে ২১৯টি কারখানার ইউডি সেবা বন্ধ করে দিতে সম্প্রতি বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে ডিআইএফই। এসব কারখানার মধ্যে ১৩৪টি বিজিএমইএর সদস্য। বাকি ৭৪ কারখানা বিকেএমইএর সদস্য। শিগগিরই এসব কারখানাও বন্ধের তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে।
এত বিপুল সংখ্যক কারখানা উৎপাদনে না থাকায় বাংলাদেশের রফতানি সামর্থ্য অনুযায়ী আয় আসছে না। তবে রফতানিতে বড় ধরনের অগ্রগতি না থাকলেও আয় কমেনি সেই হারে। কেন আয় কমেনি- জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, ছোট-মাঝারি কারখানা বন্ধ হলেও বড় মানের অনেক কারখানার সম্প্রসারণ হচ্ছে। সে কারণে রফতানি কমেনি, শ্রমিকও বেকার হয়নি। কারণ আগে থেকেই ৩০ শতাংশ শ্রমিকের ঘাটতি ছিল। তিনি জানান, বিজিএমইএর এক হাজার ১৬৩ কারখানার তালিকায় নতুন আরও কিছু কারখানা যুক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে ডিআইএফইর চিঠির কথা উল্লেখ করেন তিনি। এসব কারখানার পক্ষে নতুন করে উৎপাদনে ফেরার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, একবার বন্ধ হয়ে গেলে উৎপাদনে ফিরে আসার কাজটি অনেক কঠিন। ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। অর্থের সংস্থান থাকলে বন্ধ হতো না কারখানাগুলো। তবে নতুন করে যাতে আর কোনো কারখানা ঝরে না পড়ে সে উদ্দেশ্যে মিরসরাই পোশাক পল্লীতে ছোট-মাঝারি কারখানাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বিজিএমইএ।
জানা গেছে, আয়-ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারাই কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ। একদিকে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে কমছে পোশাকের দর। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে কমছে পোশাকের চাহিদা। এর মধ্যে সংস্কারের জন্য গড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। ছোট-মাঝারি মানের কারখানাগুলোর (এসএমই) সংস্কারে ব্যয় গড়ে ২ কোটি টাকার মতো। এসব কারখানার মালিকদের কাছে এ অঙ্কই অনেক বড়। আবার এ কারখানাগুলোতে রফতানি আদেশও আগের তুলনায় কম। এ কারণে ছোট-মাঝারি মানের কারখানাই বেশি বন্ধ হয়েছে।
সংস্কারে অর্থ সহায়তা হিসেবে আইএফসি, জাইকাসহ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থ্থা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ঋণদানে পৃথক তহবিল করেছে। উদ্যোক্তাদের হাতে আসতে সুদ বেড়ে ৯ থেকে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। এ কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন না। সংস্কারে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা ছিল অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকেও। তবে মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে গত মে মাসে মাত্র ৫ কারখানাকে ৪ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা দিয়েছে অ্যাকর্ড। বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে কয়েকটি কারখানাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে। এর বাইরে সরাসরি আর কোনো অর্থ সহায়তা দেয়নি ক্রেতারা।
বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, কারখানা বন্ধে সবচেয়ে সংকটে পড়েছে মালিকপক্ষ। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
কারখানা বন্ধের কারণে শ্রমিকরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত- জানতে চাইলে গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আক্তার জানান, কত কারখানা বন্ধ হয়েছে, তার সঠিক তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে এ কারণে কোনো শ্রমিক বেকার হয়নি। অন্যত্র কাজ নিয়েছে তারা। এই বক্তব্যে দ্বিমত আছে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগ সভাপতি সিরাজুল ইসলামের। তিনি বলেন, শ্রমিকরা যেখানে থাকে, সেখান থেকে অনেক দূরের কারখানায় কাজ করতে রাজি হয়নি অনেকেই। এ কারণে কারখানা বন্ধ হওয়ায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়েছে। অনেকে ভিন্ন পোশায় যোগ দিয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা করছে কেউ কেউ। তার মতে, বেশিরভাগ কারখানার শ্রমিকই আইন অনুযায়ী প্রাপ্য পায়নি। এ নিয়ে মালিকদের সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছে। তারা বলছেন, টাকা নেই; তাই কারখানা চালাতে পারছেন না। কাজ না করিয়ে শ্রমিকদের অর্থ দেবেন কীভাবে? অ্যালায়েন্সভুক্ত মাত্র দুটি কারখানা নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকদের অর্থ পরিশোধ করেছে বলে জানান তিনি।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এ সময় প্রধান দুই বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে দর কমেছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। আর বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে ৮ শতাংশ। এই তিন প্রতিকূলতায় বাণিজ্যিকভাবে মুনাফা কমছে পোশাক খাতে। এর প্রভাবে পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি ১৫ বছরে সর্বনিল্ফেম্ন নেমে আসে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। গত অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অথচ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের বছরেও রফতানিতে প্রবৃদ্ধি এতটা কম ছিল না। ওই বছরের এপ্রিলের পর জুন পর্যন্ত তিন মাসের খারাপ সময় সত্ত্বেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ।
সৌজন্যে- সমকাল