ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ দেশটিতে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, এক এক করে তাদের সবার নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে।
কিছুদিন আগেই বিজেপির আর এক প্রভাবশালী নেতা রাম মাধব কথিত অবৈধ বিদেশিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন, এখন রাজস্থানের একটি জনসভায় স্বয়ং বিজেপি সভাপতি বাংলাদেশিদের উইপোকা বলে আক্রমণ করলেন।
ভারতের বিরোধীদলগুলো মনে করছে, নির্বাচনের আগে স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বিজেপি আবার এই অবৈধ বিদেশিদের ইস্যু খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে; যদিও বিজেপি সে অভিযোগ মানতে নারাজ।
প্রায় সাড়ে চার বছর আগে ভারতে ভোটের প্রচারে নেমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তার সরকার অবৈধ বাংলাদেশিদের লোটাকম্বল নিয়ে ফেরত পাঠাবে।
তবে দিল্লিতে বিজেপি সরকার গড়ার পর এ নিয়ে আর কোনও সাড়াশব্দ শোনা যায়নি। কিন্তু এখন নির্বাচনের ৬-৭ মাস আগে আবার সেই একই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের মুখে।
শনিবার রাজস্থানের গঙ্গাপুরে এক জনসভায় বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকা বলে অভিহিত করে বলেন, এরা ভারতীয় যুবকদের রুটিরুজি বা চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, গরিবের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে।
‘আমি আজই ঘোষণা করছি, আগামী বছর মোদি সরকার ক্ষমতায় এলে এদের প্রত্যেককে বেছে বেছে ভোটার তালিকা থেকে বের করে দেয়া হবে।’
কিছুদিন আগেই বিজেপি নেতা রাম মাধব ঘোষণা দেন, আসামের নাগরিক তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ পড়বে তাদের বাংলাদেশে ডিপোর্ট করাটাই তাদের দলের নীতি।
কথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে বিজেপির আচমকা এভাবে তেড়েফুঁড়ে ওঠাটা ভোটের ভাবনা থেকেই, এ কথা অবশ্য মানছেন না দলের পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলি।
তিনি বলেন, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের এই অবস্থান কিন্তু জনসঙ্ঘের সময় থেকেই। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন জনসঙ্ঘ এই ইস্যুতে বহু প্রস্তাব নিয়েছে, আশির দশকে জনসঙ্ঘ থেকে যখন বিজেপি স্থাপিত হল তখন থেকে বিজেপিও এই ইস্যুতে সরব। কাজেই এটা নতুন কিছু নয়।
‘তবে হ্যাঁ, ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় নাগরিক-পঞ্জী বা এনআরসির দাবিকে আমরা লজিক্যাল কনক্লুশনে নিয়ে গেছি। কারণ যারা অর্থনৈতিক কারণে বা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভারতে আসছেন তাদের কারণে আমাদের আসাম-নাগাল্যান্ডের মতো বহু রাজ্যে রিসোর্সের ওপর প্রবল চাপ পড়ছে।’
‘এই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বহু রাজ্যে স্থানীয় সমাজে ভীষণভাবে হস্তক্ষেপ হচ্ছে, স্থানীয় সমীকরণগুলো বদলে যাচ্ছে এবং নানা ধরনের টেনশন বা উত্তেজনাও তৈরি হচ্ছে- বলছেন গাঙ্গুলি।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মালদা জেলা থেকে গত প্রায় দশ বছর ধরে নির্বাচিত কংগ্রেসের এমপি মৌসম বেনজির নূর; তিনি কিন্তু মনে করেন ‘দেশের স্বার্থ-ফার্থ’ এসব একদম বাজে কথা!
তার কথায়, সামনে ভোট আসছে- তাই এটা আসলে ধর্মের নামে মেরুকরণ করে গোটা বিষয়টার মাধ্যমে রাজনৈতিক ভোট-ব্যাঙ্ক তৈরির চেষ্টা। তা যদি না-হত, তাহলে এখন নয়; অনেক আগেই তারা ইস্যুটা তুলতেন।
কিন্তু এখন ভারতের সবচেয়ে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীদের অন্যতম বাংলাদেশ – তা সত্ত্বেও দলের শীর্ষ নেতারাই যদি বাংলাদেশিদের এভাবে আক্রমণ করেন, তাহলে বিজেপি সরকার কূটনৈতিকভাবে সেটা কীভাবে সামলাবে?
অনির্বাণ গাঙ্গুলি বলছিলেন, প্রথম কথা হল বাংলাদেশকে স্বীকার করতে হবে যে এই সমস্যাটা আছে। সে দেশের বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজ এই জিনিসগুলো ঠিকই বোঝেন, আবার তাদের অনেকে বিষয়টা ঢাকারও চেষ্টা করেন। তারা এমন ভাব করেন যেন এই সমস্যাটার কোনও অস্তিত্বই নেই!
‘এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই কূটনৈতিকভাবে আরও ভাল বোঝাপড়ার মাধ্যমে, সংলাপের মাধ্যমে – সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়টাকে দেখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে এই সমস্যাটার মোকাবেলা করা যায় সেটা ভাবতে হবে।’
‘কিন্তু তার আগে আমরা তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না, আইনগতভাবে যা করার তা আমাদের করতে হবে। কারণ আসামে একটার পর একটা জেলার ডেমোগ্রাফি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গও সেই একই রাস্তায় হাঁটছে!’
ফলে বিজেপির বক্তব্য খুব পরিষ্কার – বিগত কয়েক দশকে আসাম-পশ্চিমবঙ্গের বহু জেলা যেভাবে মুসলিমপ্রধান হয়ে উঠেছে, সেই প্রবণতা ঠেকাতেই তাদের ‘বাংলাদেশী হঠাও’ অভিযান চলবে। তার জন্য বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা উইপোকা বলে গালাগাল দিতেও কুণ্ঠিত হবেন না, মিত্র প্রতিবেশী দেশ তাতে যা-ই মনে করুক না কেন! বিবিসি বাংলা।