Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

malayasia-bangladeshiজীবিকার সন্ধানে ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে আসেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ভাগ্যের খোঁজে বেছে নেন প্রবাসজীবন। স্বপ্ন দেখে, বিদেশে গেলেই বুঝি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। দেশে পরিবার পরিজনকে সুখে রাখতে পারবে। ফিরে পাবে আর্থিক স্বচ্ছলতা। কেটে যাবে দৈন্যদশা। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, তা যখন টের পায় তখন আর কিছুই করার থাকে না। প্রবাসজীবন যে কত যাতনাময়, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানেন।

সাত বছর আগে মুন্সিগঞ্জের হাসান মালয়েশিয়ায় এসেছিলেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। কিন্তু এখানে এসে তাকে জেল-জুলুমের শিকারও হতে হয়েছে। তিনি একটি দোকানে কাজ করেন।

chardike-ad

গত ৩০ জুনে নথিভুক্ত বিদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রায় ছয় মাস আগে হাসান একটি কাজের অনুমতির জন্য আবেদন করেছিলেন।

৩ সেপ্টেম্বর পুলিশ কুয়ালালামপুরের বুকিত বিন্তাং এলাকা থেকে হাসানসহ কয়েকজনকে আটক করে এবং হাতকড়া লাগিয়ে কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় বসার জন্য বাধ্য করে। তারপর তাদের একটি ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায় পুলিশ। হাসান প্রমাণ করার জন্য সব বৈধ দলিলপত্র ইমিগ্রেশন পুলিশকে দেখিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক বোঝানোর পরও তাকে ছাড়া হয়নি। কয়েক বছর ধরে মালয়েশিয়ার রাজধানীতে বসবাস হাসানের। অবশেষে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে পুলিশ কর্মকর্তাকে লক্ষাধিক টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল তার।

তিনি বলেন, ক্যাম্পে সব বন্দিকে বস্ত্রহীন অবস্থায় রাখা হয়েছিল। সেখানে সব ধরনের শ্রমিক ছিল। যাদের কারও কারও বৈধ কাগজপত্র ছিল। আবার কারও কারও কাগজপত্র ছিল না। এদের মধ্যে অনেককেই কান ধরে ওঠবস করানো হয়।

হাসান বলেন, ‘আমি কেন আটক ছিলাম এবং ক্যাম্পের বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। ক্যাম্পে দায়িত্বরতরা বন্দিদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। আমি সাত বছর আগে মালয়েশিয়া এসেছিলাম এবং আমার নিয়োগকর্তা আমার ভিসা নথিভুক্ত করে। আপনি আমাকে বলুন, কী আমার দোষ ছিল। মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীদের, ন্যায়বিচার কোথায়? এখানে আমাদের (বাংলাদেশিদের) কোনো মর্যাদা নেই।’

হাসানের মতো, অনেক বাংলাদেশি একই ধরনের আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ ৩০ জুন পুনর্বাসন কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর মালয়েশিয়া অনিয়মিত অভিবাসীদের ওপর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইমিগ্রেশন বিভাগ। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কর্মসূচি চলাকালীন কর্মজীবনের জন্য আবেদন করা সত্ত্বেও তারা সমস্যায় পড়ছেন।

জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক মুস্তাফার আলী বলেন, অভিযান অব্যাহত থাকবে। ১৪ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বার্নামার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আটক বাংলাদেশিদের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে ৪ সেপ্টেম্বর মুস্তাফার জানান, জানুয়ারি থেকে ৩০ হাজার বিদেশি কর্মীকে আটক করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬ হাজার বাংলাদেশি।

বর্তমানে, প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটি রয়েছেন। তাদের মধ্যে, প্রায় অর্ধেক অভিবাসী। তাদের অধিকাংশই কাজের অবস্থা নিয়মিতকরণের জন্য প্রযোজ্য এবং প্রক্রিয়াগুলোর জন্য ৬ থেকে ১০ হাজার রিংগিট ব্যয় করেন। তবে প্রায় ৮০ শতাংশ এখনও পারমিট না পাওয়ায় অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে দিন পার করছেন।

বেশিরভাগ অভিবাসী এ কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে আসছেন, অভিবাসীরা তাদের নিয়োগকর্তা ও শ্রম দালালের হাত থেকে শোষণের কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নথিভুক্ত নন। তারা বলেন, যারা কাজ এবং পারমিটের জন্য আবেদনপত্র দাখিল করে তাদের আটক করা অভিবাসন আইনের লঙ্ঘন।

কুয়ালালামপুরে অভিবাসীদের প্রাণকেন্দ্র কোটারায়াতে বসবাসকারী একজন বাংলাদেশি নাঈমুল হক বলেন, তাকে ১ জুলাই থেকে ১৭ দিন ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি অত্যন্ত অপমান বোধ করেন। নাঈমুলকে অন্য দুই কর্মীর সঙ্গে আটক রাখা হয়েছিল এবং মেঝেতে বসতে হয়েছিল। তাকে প্রথম দিন কোনো খাবার দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমাদের তিনজনকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, আমাদের চেক করেছিল। এবং ৫০ বার কান ধরে ওঠবস করিয়েছিল।’ তার প্রশ্ন, ‘আমাদের অপরাধ কি ছিল?’ যার কোনো উত্তর মেলেনি।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্ট অনুসারে, মালয়েশিয়ায় অভিবাসন ক্যাম্প অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক এবং আটক স্থানগুলোর জন্য সর্বনিম্ন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক কম। অভিবাসন কেন্দ্রে বন্দিদের বিছানা, পরিষ্কার পানি, ওষুধ এবং পর্যাপ্ত খাবার এবং অক্সিজেনের অভাব।
নাঈমুল বলেন, ‘বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও মিয়ানমারের প্রায় ৪ হাজার ০০০ কর্মীকে ক্যাম্পে অমানবিকভাবে বন্দি রাখা হয়েছিল। বেশিরভাগ ছিল বাংলাদেশি।’

কারাগার আরও ভয়ঙ্কর: বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি অভিবাসী বলেন, শিবিরের চেয়ে কারাগারে পরিস্থিতি খারাপ ছিল। শহীদুল ইসলামের (৩৩) আবেদনপত্রের সব কাগজপত্র থাকলেও তাকে ২০১৬ সালে পাঁচ মাসের জন্য জেলে রাখা হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘আমাকে পাঁচবার আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার কোনো আইনজীবী ছিল না। পাঁচ মাস পর, আমি মুক্তি পেয়েছিলাম কারণ আমার নথি বৈধ ছিল।’

সেলেঙ্গার একটি ফ্যাক্টরিতে কর্মরত শহীদুল ইসলাম বলেন, কারাগারে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ বন্দিকে রাখা হয়েছিল, যার মধ্যে ২৫ জনকে সাময়িকভাবে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। কারাগারের দিনগুলোতে আমি ফিরে আসার কথা ভাবতাম। আমি প্রতি রাতে কাঁদতাম।’

কুয়ালালামপুরের একটি অধিকার সংস্থা উত্তর সাউথ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক অ্যাড্রিয়ান পেরেরা বলেন, অভিবাসীদের নির্বিচারে গ্রেফতার নতুন কিছু নয়। তিনি বলেন, ‘অনেক অভিবাসী ধরপাকড়ের কাহিনী আমাদের বলে কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করতে ভয় পায়। কারণ তারা সাক্ষী সুরক্ষা ব্যবস্থায় আস্থা রাখে না এবং এমনকি নাগরিক সমাজ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না।’

তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘অভিবাসীদের অবস্থা যাচাই করা যেতে পারে। যারা দস্তাবেজ ধারণ করে তাদের “কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতার লজ্জাজনক অপব্যবহার এবং সরকারি সংস্থার বর্জ্য” বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অভিবাসীদের প্রতিকারের জন্য কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করার এবং দুর্নীতি ও অধিকার লঙ্ঘনের চক্রটি শেষ করার জন্য নিরাপদ উপায় খুঁজে বের করা উচিত।’

মালয়েশিয়ার ক্ল্যাংয়ের এমপি চার্লস সান্টিয়াগো অভিবাসীদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা জানিয়ে আসছেন। এমপি চার্লস সান্টিয়াগো অভিবাসীদের গ্রেফতার না করে সুষ্টু সমাধানের জন্য সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করবেন বলে জানান তিনি।

এদিকে ভয়ে ভয়ে দিন কাটানো বাংলাদেশিরা অনেকেই অভিযোগ করছেন, কথিত এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হওয়ায় তারা সে দেশে বৈধ শ্রমিকের স্বীকৃতি পাননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশি শ্রমিকরা না বুঝে ভুয়া এজেন্টদের হাতে চার থেকে পাঁচ হাজার রিংগিত তুলে দেয়। তাদের আঙুলের ছাপও নেওয়া হয়। কিন্তু টাকা নিয়ে কাজ করে না দেওয়ায় তারা আর বৈধ হতে পারেনি।

লেখক- আহমাদুল কবির, সৌজন্যে- জাগো নিউজ