১৯৯০ সাল, বাংলাদেশের সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে হুট করেই গায়েব হয়ে যেতে থাকলো নাবালক মেয়েরা। তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুজব রটেছিল, ‘ওলাদচক্র’ নামে শয়তানের উপাসক একটা গোষ্ঠী এসব নাবালিকা মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে ইফরিত নামের এক খারাপ জ্বীনের বংশবৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করেছিল। ইসলামে বুখারী হাদীসে ইফরিতের কথা উল্লেখ আছে, এরা খুবই খারাপ ধরনের ভয়ঙ্কর প্রজাতীর জ্বীন, মানুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এরা মাত্র ২৯ দিনের মধ্যে সন্তান জন্ম দিতে পারে।
উপরে যে ঘটনাটার কথা বললাম, এটার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। তবে সাতক্ষীরার কলারোয়া, শ্যামনগর, দেবহাটা বা সুন্দরবন সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে এই ঘটনাটা সেই সময়ে বেশ সাড়া ফেলেছিল। তিলকে তাল বানালে যা হয় আরকি, হয়তো দু-চারজন নাবালিকা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল, সেটার সঙ্গে ইফরিত বা ওলাদচক্রকে মিশিয়ে এসব কল্পকাহিনীর জন্ম নিয়েছিল সেই সময়ে। এখনও এসব এলাকার মধ্যবয়স্ক মানুষেরা এই ঘটনাকে সত্যি বলেই মনে করেন।
যাই হোক, এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। সাতক্ষীরার এই প্রচলিত লোককাহিনী নিয়ে বলিউড একটা আস্ত সিনেমা বানিয়ে ফেলেছে, সিনেমার নাম পরি। আনুশকা শর্মা এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন এতে, আরও আছেন রজত কাপুর এবং ঋতাভরি চক্রবর্তী। যারা পরি দেখেছেন, তারা জানেন, কি দুর্দান্ত একটা কাজ হয়েছে সেটা। বলিউড হরর সিনেমা বানাতে পারে না বলে যে দুর্নামটা ছিল অনেক বছর ধরে, সেটা ভেঙে দিয়েছে আনুশকা শর্মার পরি।
আরেকটা গল্প শোনাই। প্রায় চারশো বছর আগের কথা। মোঘল সম্রাট শাহজাহানকে হত্যা করে দিল্লির ক্ষমতা দখল করেছেন তার পুত্র আওরঙ্গজেব। সেটার বিরোধীতা করলেন আওরঙ্গজেবের অপর তিন ভাই দারাশিকো, মুরাদ আর শাহ সুজা, আর তাই আওরঙ্গজেবের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো তাদের। পরাজিত হয়ে মারা পড়লেন দারাশিকো আর মুরাদ।
শাহ সুজা তখন বাংলার শাসনকর্তা, বর্তমান চাঁপাই-নবাবগঞ্জ সীমান্তের পাশেই মালদহের কাছাকাছি তার রাজধানী ছিল। সুজাকে ধরার জন্যে বাহিনী পাঠালেন আওরঙ্গজেব, প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমান ঢাকার ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে আরাকানে পাড়ি জমালেন সুজা। যাবার আগে সব ধনসম্পত্তি রেখে গেলেন তার বিশ্বস্ত কয়েকজন জমিদারের কাছে। আরাকানে গিয়েও বাঁচতে পারেননি সুজা, সেখানকার রাজা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেন তাঁকে। সুজার রেখে যাওয়া সম্পদের কোন হদিস আর পাওয়া যায়নি কখনও, যেসব জমিদারের কাছে তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তারাও স্বীকার করেননি।
কি চমৎকার একটা গল্প, আমাদের গল্প, আমাদের মাটির গল্প, সেই গল্পটাকে নিয়ে কি আমরা সিনেমা বানাতে পারতাম না? নিশ্চয়ই আমাদের সেই সামর্থ্য ছিল, কিন্ত আমরা পারিনি। কলকাতা কিন্ত ঠিকই আমাদের এই গল্পটাকে উপজীব্য করে সিনেমা বানিয়ে ফেলেছে। ধ্রুব বন্দোপাধ্যায় নামের এক আনকোরা পরিচালক তার প্রথম সিনেমার বিষয়বস্তু হিসেবেই বেছে নিয়েছেন শাহ সুজার ফেলে যাওয়া সম্পদের রহস্যটিকে। অথচ আমাদের পোড়খাওয়া অনেক পরিচালক হয়তো এটা নিয়ে কখনও ভাবেনইনি!
আমাদের দেশের কয়জন মানুষ ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার কথা জানেন? মৃত্যুর বারো বছর বাদে ফিরে এসেছিলেন ভাওয়াল এস্টেটের রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ। তার জমিদারীর এলাকা ছিল ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে। সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ এই রাজার মৃত্যু হয়েছিল দার্জিলিঙে, সেখানে তার শবদেহ পোড়ানো হয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন উপস্থিত লোকজন। রাজার এই ফিরে আসার ঘটনাটা সেই সময়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল পুরো ভারতবর্ষে, এমনকি সুদূর বিলেতেও।
ভাওয়াল রাজার কাহিনীর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে রহস্য আর রোমাঞ্চের আঁচ। ঢাকায় ফিরে আসার পরে নিজের জমিদারী ফিরে পেতে কোর্টে মামলা করেছিলেন রমেন্দ্রনারায়ণ, ইতিহাসে সেটাই বিখ্যাত ‘সন্ন্যাসী রাজার মামলা’ নামে পরিচিত। আদালতে তাঁকে প্রমাণ দিতে হয়েছিল যে, তিনিই সেই ভাওয়াল রাজা। মামলাটা চলেছিল দীর্ঘ ষোল বছর ধরে, শেষমেশ বিচারকদের রায়ে সন্ন্যাসী রাজাকে ভাওয়াল এস্টেটের রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ হিসেবে সাব্যস্ত করে তার হাতে আবারও জমিদারী তুলে দেয়া হয়।
ভাওয়াল রাজা আমাদের এলাকার মানুষ, ভাওয়াল এস্টেটের অবস্থান ছিল বর্তমান গাজীপুরে। অথচ আমাদের দেশের কোন পরিচালক কখনও এই চাঞ্চল্যকর মামলাটি নিয়ে, বা ভাওয়াল রাজার এমন ব্যতিক্রমী জীবনটা নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা ভাবেননি। কিংবা ভাবলেও সেটা আলোর মুখ দেখেনি। অথচ কলকাতায় এই গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়েছে অনেক আগেই, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ নামের সেই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার। এবার সৃজিত মূখার্জী সেই ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা নিয়েই আবার সিনেমা বানাচ্ছেন, সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছেন যীশু সেনগুপ্ত, আছেন আমাদের জয়া আহসানও। সিনেমার নাম ‘এক যে ছিল রাজা’।
চট্টগ্রামে বৃটিশ অস্ত্রাগারে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের আক্রমণের ওপরে বলিউডে ‘চিটাগাং’ নামের সিনেমা বানানো হয়েছে, আমরা কি কিছু বানাতে পেরেছি এটা নিয়ে? প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে নিয়ে কি একটা সিনেমা বানানো উচিত ছিল না আমাদের? একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ঘটনাটা চমৎকারভাবে তুলে ধরে ভারতে একটা শর্টফিল্ম বানানো হয়েছে, যেটার নাম ‘মুক্তি’। সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রত্যেককে নিয়ে সিনেমা বানানো যেতো বাংলাদেশে, আমরা পারিনি।
আমাদের সত্যি ঘটনাগুলো নিয়ে ভারতের নির্মাতারা সিনেমা বানিয়ে ফেলেন, আমাদের প্রচলিত লোককাহিনীগুলোও সেখানকার সিনেমার জন্যে দুর্দান্ত প্লট হয়ে যায়, আর আমরা তাদের তামিল-তেলুগু ঢিশুম ঢিশুম টাইপের সিনেমাগুলো দেদারসে নকল করি। আমরা নিজেদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সম্পদের দিকে তাকাই না, সেগুলো অন্য দেশের মেধাবী নির্মাতারা খুঁজে বের করে ফেলেন, আর আমরা বসে বসে তাদের অখাদ্য টাইপের সিনেমাগুলোর নকল আর রিমেক বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকি!