কক্সবাজারের টেকনাফে এক অনুষ্ঠানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম জহির হোসেন স্থানীয় এমপি আবদুর রহমান বদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বদি এমনই জনপ্রিয় যে আগামী ভোটে শেখ হাসিনা এসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাঁর কাছে বিপুল ভোটে হেরে যাবেন।’ এমপি বদির উপস্থিতিতে তাঁর ‘ডান হাত’ হিসেবে পরিচিত জহির হোসেনের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে এলাকায় তোলপাড় চলছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। জহির হোসেনের শাস্তিও দাবি করেছে দলের অনেক নেতাকর্মী। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ প্রতিবাদসভারও ডাক দিয়েছে।
জানা যায়, এমপি বদির নির্দেশনায় গত শনিবার এক ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রবিউল হাসান। উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ইউএনওর সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে এমপি আবদুর রহমান বদি ছিলেন প্রধান অতিথি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সমালোচিত টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিএনপি নেতা জাফর আহমদ। এমপি বদির সমর্থক হিসেবে পরিচিত কয়েকজন দলীয় নেতাও উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে টেকনাফের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য এমপি বদির ব্যাপক প্রশংসা করে বক্তব্য দেয় বদির সমর্থকরা। একপর্যায়ে সভায় উপস্থিত কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও শাহপরীর দ্বীপ সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি সোনা আলী মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তিনি টেকনাফ সীমান্তের উন্নয়নের জন্য মেরিন ড্রাইভ সড়ক, সাবরাং অর্থনৈতিক জোনসহ প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত সব প্রকল্পের বিবরণ দিতে থাকেন। কিন্তু এমপি বদি তাঁকে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করতে তাগিদ দেন। তবু তিনি বক্তব্য অব্যাহত রাখলে একপর্যায়ে তাঁর মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা হাজি সোনা আলী পরে অভিযোগের সুরে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমপি বদি সব সময় এলাকাবাসীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর অবদানকে খাটো করে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিজের বলেই জানান দিয়ে আসছেন। তিনি (এমপি বদি) কোনো সময়েই সীমান্ত এলাকায় শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেন না। বরং নিজের উদ্যোগেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করে আসছেন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালান।’
অনুষ্ঠানে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম জহির হোসেন। তিনি গতকাল রবিবার দুপুরে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি অনুষ্ঠানে যা বলার সবই বলেছি। এমপি বদির সঙ্গে কোনো বিশ্বনেতারও তুলনা চলে না। এমনকি শেখ হাসিনা এসেও ভোট করে এমপি বদির হাতে পরাজিত হবেন।’ তিনি আরো বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, সদস্য ও সমর্থকদের ভোটই এমপি বদির জন্য যথেষ্ট।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা এম জাহির হোসেনের বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর। তিনি কোনোভাবেই একজন দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এভাবে তুলনা করতে পারেন না।’ ইউএনও জানান, জহির ওই বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি সভা থেকে অন্যত্র কাজে গিয়েছিলেন। তার পরও সভায় এ রকম বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করা হবে। সেই সঙ্গে এমন আপত্তিকর বক্তব্য নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি এমপি আবদুর রহমান বদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে এম জহির হোসেনের দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। তিনি শুধু বলেন, ‘ঈদের দাওয়াতে আপনারা সবাই আসেননি। তাই আমি ইউএনওর মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করি।’ তিনি ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা জনপ্রতি ২০০ করে লোকের তালিকা প্রস্তুত করে রাখবেন। যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা আসছে। সবাইকে বরাদ্দ দেওয়া হবে।’
তবে পরে এ বিষয়ে এমপি বদির বক্তব্য জানতে চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইউনুস বাঙ্গালী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমপি বদিকে দেশের সেরা একজন জনপ্রিয় নেতা বানাতে গিয়ে এম জহির হোসেন অহেতুক শিষ্টাচারবিবর্জিত বক্তব্য দিয়েছেন, যার সঙ্গে সঙ্গেই আমি প্রতিবাদও জানিয়েছি।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান এইচ কে আনোয়ার বলেন, জাতির জনকের কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে পুরো অনুষ্ঠানের ভাবমূর্তি শেষ করে দেওয়া হয়েছে।
টেকনাফের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের সদস্য শফিক মিয়া বলেন, এ রকম বিতর্কিত বক্তব্য দানকারী দলীয় নেতাকর্মীরাই যুগে যুগে একটি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ওত পেতে থাকে। ওই নেতার কঠোর শাস্তি দাবি করেন তিনি।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমপি আবদুর রহমান বদির দীর্ঘদিনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে এখন আর তাঁর ডাকে কোনো দলীয় নেতাকর্মী সাড়া দিচ্ছে না। তিনি (এমপি বদি) শেষ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা ইউএনওকে দিয়ে ঈদ পুনর্মিলনীর নামে নির্বাচনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে পর্যন্ত বিতর্কের সৃষ্টি করে চলেছেন।’ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘দলীয় সভাপতি ও বিশ্বনন্দিত নেত্রীকে এমপি বদির মতো একজন বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করায় এম জহির হোসেনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
মোহাম্মদ আলী জানান, ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান আয়োজনের খবর পেয়ে তিনি ইউএনওকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে এমপির নির্দেশে এ রকম আয়োজন করে সরকারকে বিব্রত না করা হয়। কিন্তু ইউএনও সেই অনুরোধ উপেক্ষা করেই তা করেছেন।
টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাবেদ ইকবাল চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনে উখিয়া-টেকনাফবাসী এমপি আবদুর রহমান বদিকে মনোনয়ন না দিতে দলীয় নেতাকর্মীরা নানাভাবে আন্দোলনে নেমেছে। আর তখনই পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে নেওয়ার জন্য বদি নিজেই এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছেন অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে।’
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘দলের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীই এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রয়েছে। এমন অবস্থায় তিনি আর মনোনয়ন পাবেন না আঁচ করতে পেরেই সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে রাজনৈতিক আয়োজনের ব্যবস্থা করে দলকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন।’
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেকনাফে একজন এমপিকে জনপ্রিয় দেখাতে গিয়ে যিনি খোদ দলীয় প্রধান এবং বিশ্বনন্দিত নেত্রী জাতির জনকের তনয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে তুলনা করেছেন, তিনি সাংগঠনিক অপরাধ করেছেন। এমন দলীয় নেতার বিরুদ্ধে জেলা আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা নেবে।’
সূত্রঃ কালের কন্ঠ।