সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলা ছাত্র আন্দোলনের সময় উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান কিংবা কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, দৃক-এর প্রতিষ্ঠাতা শহীদুল আলমকে গ্রেফতার৷
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও উসকানি ছড়ানোর অভিযোগে প্রখ্যাত এই আলোকচিত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ উসকানির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার আতঙ্কে আছেন আরো অনেকেই৷ কেউ কেউ আন্দোলনের সমর্থনে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস মুছে ফেলছেন বলেও জানা গেছে৷
যিনি আন্দোলনের সমর্থনে লেখালেখি করেছেন তিনি ভেবেছেন এটি একটি ন্যায্য আন্দোলন৷ তাই তিনি আন্দোলন সমর্থন করেছেন৷ আবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে ‘সমর্থনের’ নামে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে ‘উসকে’ দিচ্ছে৷ সরকার মনে করেছে এটা ‘উসকানি’৷ দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের সমর্থনকারীদের কাছে বিষয়টি হলো ‘ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন’ আর সরকারের কাছে এটি ‘উসকানি’৷
‘উসকানি’ বিষয়টি কি তাহলে ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন রকম? কিংবা উসকানি কি উপলব্ধিজনিত, কে কীভাবে একটি তথ্যকে ব্যাখ্যা করে তার উপর নির্ভর করে? কোনো বক্তব্য উসকানিমূলক কিনা, সেটি নির্ধারিত হবে আইন দ্বারা৷ বাকস্বাধীনতা বিষয়ে আমাদের দেশে বিদ্যমান আইন সরকারকে উসকানি নির্ধারণের বৈধতা দিচ্ছে৷ বিষয়টি যদি আইন দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে কারো কাছে এটা ‘উসকানি’ আবার আবার কারো কাছে এটা ‘আন্দোলনকে সমর্থন’ কেন?
বাকস্বাধীনতা বিষয়ে আমাদের দেশের সংবিধান প্রণীত ধারাসমূহ এবং এ সংক্রান্ত প্রণীত অন্যান্য আইনসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরণের শর্ত জুড়ে দেয়ার মাধ্যম এ আইনসমূহ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশকেই বাধাগ্রস্ত করেনি বরং জুড়ে দেয়া শর্ত সমূহকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে৷ শর্ত সমূহের এ নানাবিধ ব্যাখ্যা প্রদানের সুযোগ থাকার কারণে কারো কাছে এটি হয়ে ওঠে ‘উসকানি’ আর কারো কাছে তা ‘মতপ্রকাশ’৷
নাগরিককে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে বাংলাদেশের সংবাধান৷ সংবিধানের ৩৯ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্র নাগরিককে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করেছে৷ পাশাপাশি সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দানের কথাও বলেছে৷ তবে কিছু শর্তও দিয়েছে৷ যেমন বলা হয়েছে, এ স্বাধীনতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রদান করা হচ্ছে৷
দেখা যাচ্ছে, সংবাধান নাগরিককে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করছে, তবে তা অনেকগুলো শর্তের অধীনে বাস্তবায়নযোগ্য৷ এ শর্ত সমূহের ব্যাখ্যা বহুবিধ হতে পারে৷ যেমন জনশৃংখলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ-সাপেক্ষে নাগরিককে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করছে সংবিধান৷ এক্ষেত্রে জনশৃংখলার লঙ্ঘন কীভাবে নির্ধারিত হবে? আন্দোলনকারীরা বলছে, তারা যে আন্দোলনটি করেছে সেটি জনশৃংখলার সাময়িক লঙ্ঘন হলেও এ আন্দোলনটি করার অধিকার তারা রাখে৷
আবার আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ বলতে আমরা কী বুঝব বা যুক্তিসংগত বাধা নিষেধের সীমা কোনটি হবে? এটি এমন এক বিষয় যা আমাদের উপলব্ধি করে নিতে বা বুঝে নিতে হবে যে, বাকপ্রকাশের সীমানা কতটুকু হলে তা যুক্তিসংগত পর্যায়ে থাকছে৷ এক্ষেত্রে বিষয়টি নির্ভর করছে প্রেক্ষাপটটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তার উপর৷
জোহান গালটুং নামে নরওয়ের বিখ্যাত একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন বিবাদ, সংঘাত, লড়াই, এক কথায় সংঘর্ষ আসলে নির্ভর করে ফ্রেমিং এর উপর অর্থাৎ একটি বার্তাকে বিবাদমান পক্ষের কাছে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তার উপর৷ প্রশ্ন দাঁড়ায়, সংঘাত বা বিবাদ কি তাহলে উপস্থাপনজনিত উপলব্ধির বিষয়? তর্ক যাই থাকুক, একটি বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীরা একমত যে অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়সমূহের উপলব্ধি নির্ভর করে বিষয়টিকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার উপর৷ যেমন নৃবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন দারিদ্র্যতা হচ্ছে উপলবদ্ধির বিষয়৷ আমার প্রতিবেশী একটি দামি গাড়িতে করে তাঁর কর্মস্থলে যাচ্ছে, আর আমি যাচ্ছি পায়ে হেঁটে৷ এক্ষেত্রে আমি যে সমাজে বসবাস করছি সেই সমাজের প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী যে ব্যক্তির গাড়ি আছে, সে ব্যক্তি ধনী৷ তাহলে কি আমি গরিব? এই ব্যাখ্যাটিতো অন্যভাবেও হতে পারতো৷
তাহলে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯নং ধারার শর্তসমূহের ক্ষেত্রেও ব্যাখ্যাজনিত উপলব্ধির এ বিষয়টি প্রযোজ্য? আর যদি তাই হয়ে থাকে, ক্ষমতায় থাকা গোষ্ঠী তাঁদের নিজেদের মতো করে কি শর্তসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করছে এবং এর মধ্য দিয়ে জনগনের বাকস্বাধীনতার অধিকারকে সীমিত করছে?
একই ধাঁধায় আটকে আছে সম্প্রতি খসড়া হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮৷ এ আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয় দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করেন, তাহলে তিনি ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে তার ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা হবে৷ এরকম আরো বেশ কিছু ধারা এ আইনটিতে রয়েছে যেটির বহুবিধ ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে৷ যেমন জনগণকে ভয় দেখানো বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ইত্যাদি বিষয়গুলো নির্ভর করছে এগুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তার উপর৷ এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো আরো বেশি সুনির্দিষ্ট করার মাধ্যমে বহুবিধ ব্যাখ্যা প্রদানের যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে তা এড়ানো যেতে পারে৷
বাকস্বাধীনতা বিষয়ে বাংলাদেশের আইনের সাথে ইউরোপের কয়েকটি দেশের আইনের একটি তুলনামূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে দেখা যেতে পারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সংবাধান কীভাবে তার নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করছে এবং এ সংক্রান্ত জটিলতা কীভাবে সমাধান করছে৷
জার্মানি: জার্মান সংবিধানের ৫ নং ধারা নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছে৷ জার্মান সংবিধান অনুযায়ী যে কোনো নাগরিক তাঁর মতপ্রকাশের (লিখিত, মৌখিক কিংবা চিত্র) বাধাহীন অধিকার রাখে৷ একইভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয় সংবাধান৷ শর্ত থাকে যে, মতপ্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তি অন্য কোনো আইনের লঙ্ঘন, অন্য কোনো ব্যক্তির মানহানি কিংবা তরুণ/শিশু অধিকার লঙ্ঘন করতে পারবে না৷ তবে জার্মান আইন অনুযায়ী কেউ হলোকস্ট বিষয়ে কোনো আলোচনা বা প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদিদের উপর চালানো হত্যাকাণ্ডেকে বলা হয় হলোকস্ট৷ পাশাপাশি বলা হচ্ছে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে কোনো আইন প্রণয়নের সময় বিবেচনায় রাখতে হবে এটি সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কিনা৷
ফ্রান্স: ফ্রান্সের নাগরিকরা তাদের সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীনভাবে যে-কোনো বিষয়ে মতপ্রকাশের অধিকার রাখে৷ ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পর ‘রাইট ডিক্লারেসন’ এর আওতায় দেশটির নাগরিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার দেয়া হয়েছে৷ পরে বিভিন্ন সময়ে কিছু আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অবাধ মতপ্রকাশকে কিছুটা সীমিত করা হয়৷ যেমন নাগরিকরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে তবে তা যেন কোনোভাবেই বর্ণবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মানহানি, অপবাদ, ঘৃণা ছড়ানো ও মানকতাবিরোধী অপরাধকে সমর্থন না করে৷
ইউরোপিয়ান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটস: ইউরোপের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ, ইউক্রেন, সার্বিয়া, জর্জিয়া সহ প্রায় ৪৭টি দেশের সংগঠন ‘ইউরোপিয়ান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটস’৷ এর ১০ নং ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে তাঁর মতামত লালন ও প্রদানের স্বাধীনতা প্রদান করবে৷ এক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানাও থাকবে না৷ তবে শর্ত থাকে যে, স্বাধীনভাবে এ মতপ্রকাশ কোনোভাবেই গণতন্ত্র, জাতীয় নিরাপত্তা, জনসাধারণের নিরাপত্তা, সদস্য রাষ্ট্রসমুহের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা, ঘৃণা ছড়ানো, নৈতিকতার অবক্ষয় ও আদলতের কর্তৃত্বের উপর কোনো আঘাত হানবে না৷
এই আইন অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রসমূহ স্থানীয়ভাবে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না, যা ইউরোপিয়ান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটস এর ১০নং ধারার সাথে সাংঘর্ষিক৷ সদস্যরাষ্ট্রসমূহ স্থানীয়ভাবে কোনো আইন প্রণয়ন করার সময় তাদেরকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, এই আইন নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূলনীতি ও স্বাধীন সাংবাদিকতার যেন বাধা না হয়৷ ইউরোপিয়ান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটস এর ১০ নং ধারার অন্যতম একটি ধারা বলছে, কোনো সদস্য রাষ্ট্র এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না যা নাগরিকের কাছে বোধগম্য হবে না৷
লেখক: রাহাত রাফি, ডয়চে ভেলে