শেষ পর্যন্ত গ্রুপ পর্বে বিদায় নিলেও দক্ষিণ কোরিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ রাঙিয়েছেন। তিন ম্যাচে করেছেন দুই গোল, যার মধ্যে একটি আবার জার্মানিকে ২-০ গোলে হারানোর ম্যাচে। টটেনহামের জার্সিতে প্রিমিয়ার লিগ তো অনেক দিন ধরেই মাতিয়ে আসছেন। কিন্তু সেসব নয়, সন হিউং-মিনের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় চলতে থাকা এশিয়ান গেমস। এখানে সোনা না জিতলে যে দুই বছরের জন্য ফুটবলকে বিদায় বলে দিয়ে কাজ করতে হবে সামরিক বাহিনীতে। যার অর্থ, ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যাবে টটেনহামের দক্ষিণ কোরিয়ান ফরোয়ার্ডের।
দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ম, যেকোনো সুস্থ-সবল যুবককেই বয়স ২৮ হওয়ার আগে সামরিক বাহিনীতে নাম লেখাতে হবে, কাজ করতে হবে অন্তত ২১ মাস। কারও জন্যই এতে ছাড় নেই। সেরা ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে নিয়মটা একটু শিথিল হয় অলিম্পিক বা বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে পদক জিততে পারলে। এশিয়ার আঞ্চলিক ‘অলিম্পিকে’র এশিয়ান গেমসের ক্ষেত্রে যেকোনো পদক হলেই চলবে না, সনকে জিততে হবে সোনাই। ২৬ বছর চলছে তাঁর, ২০২০ অলিম্পিক শুরু হওয়ার মাত্র ১৬ দিন আগেই ২৮-এ পা দিয়ে ফেলবেন। এটাই তাই শেষ সুযোগ।
সন অবশ্য নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন। সর্বশেষ এশিয়ান গেমসের ফাইনালে সর্বক্ষেত্রে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর কোরিয়াকে হারিয়ে সোনা জিতেছিল দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু সনের তখনকার ক্লাব বায়ার লেভারকুসেন তাঁকে ছাড়েনি বলে সেটিতে খেলা হয়নি তাঁর। এশিয়ান গেমস ফিফার টুর্নামেন্ট নয়, ক্লাবগুলো তাই খেলোয়াড় ছাড়তে বাধ্য নয়। এবার টটেনহাম যে ছেড়েছে, সেটিও বিশেষ শর্তে।
দক্ষিণ কোরিয়া ফাইনালে উঠলে লিগে ফুলহাম, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ওয়াটফোর্ডের সঙ্গে ম্যাচগুলোতে খেলা হবে না সনের। সেটি জেনেও টটেনহামের তাঁকে না ছেড়ে উপায় ছিল না। টুর্নামেন্টে দক্ষিণ কোরিয়া শিরোপা না জিতলে শুধু তো সন বা দক্ষিণ কোরিয়া জাতীয় দল নয়, টটেনহামের জন্যও সেটি হবে বড় ধাক্কা। ক্যারিয়ারের সেরা সময় চলছে এখন সনের, দুই বছরের জন্য তাঁকে কেই-বা হারাতে চাইবে! গত জুলাইয়েই পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করা সনকে তাই এশিয়ান গেমসে খেলার অনুমতি টটেনহাম দিয়েছে এই শর্তে যে, আগামী জানুয়ারিতে এশিয়ান কাপে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম দুটি ম্যাচের জন্য ছাড়া হবে না সনকে। টটেনহাম তাঁকে ছাড়বে না নভেম্বরে একটা প্রীতি ম্যাচের জন্যও।
নিউক্যাসলের বিপক্ষে গত শনিবার প্রিমিয়ার লিগে টটেনহামের প্রথম ম্যাচটি খেলেই সন চলে এসেছেন সাত হাজার মাইল দূরের জাকার্তায়। সন্দেহাতীতভাবে প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ গোল করা এশিয়ান গেমসের ফুটবলে সবচেয়ে বড় তারকা। দক্ষিণ কোরিয়াও অন্যতম ফেবারিট। অন্যতম, কারণ জাপান-ইরান-সৌদি আরবের মতো রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা দলগুলোও আছে এখানে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ওই দলগুলোর পার্থক্য, মূলত অনূর্ধ্ব-২৩ দলের এই টুর্নামেন্টে দলে তিনজন বেশি বয়সী খেলোয়াড় নেওয়ার সুযোগটা দক্ষিণ কোরিয়া নিয়েছে, অন্য বড় দলগুলো নেয়নি। সনের পাশাপাশি ‘বেশি বয়সী’ আর যে দুজনকে নিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, বিশ্বকাপে খেলা সেই গোলরক্ষক জো হিউওন-উ ও জাপানি লিগে খেলা স্ট্রাইকার হোয়াং উই-জোর জন্যও এশিয়ান গেমস সেনাবাহিনীকে ‘এড়ানোর’ শেষ সুযোগ।
কিন্তু জিততে না পারলে? হয়তো এই মৌসুমই হয়ে থাকবে প্রিমিয়ার লিগে সনের শেষ। টটেনহামের আধুনিক অনুশীলন সুবিধা, লন্ডনের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হবে মিলিটারি ব্যারাকে, যেখানে এক কক্ষে ঘুমাতে হয় ৩০ সৈনিককে। কখনো হয়তো রাত-বিরাতে রাস্তায় টহল দিতে হবে, হয়তো দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে উত্তর কোরিয়াকে তফাতে রাখা সীমান্তেও। খাওয়াদাওয়া গত এক দশকে নাকি কিছুটা ভালোই হয়েছে। মধ্যযুগীয় খাবারের বদলে এখন সৈন্যরা পান ভাত, মাছ, মাংস, সুপ আর দক্ষিণ কোরিয়ান জাতীয় খাবার ‘কিমচি’। বেতন হবে মাসে ২৭৫ ডলার, সনের এখনকার সাপ্তাহিক বেতনই যেখানে ১ লাখ ডলারের বেশি!
এত কিছুর পরও দক্ষিণ কোরিয়ার সেরা ফুটবলারদের জন্য একটা রাস্তা খোলা থাকে। সেনাবাহিনীতে থাকার বদলে ওই ২১ মাস কোরিয়ার সর্বোচ্চ লিগ কে-লিগে সামরিক বাহিনীর দল সানজু সাংমুতে খেললেই হয়। কিন্তু সেটির জন্য আগে কোরিয়ান কোনো একটা ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। ১৬ বছর বয়সেই বাড়ি ছেড়ে জার্মানির হামবুর্গের একাডেমিতে চলে যাওয়া সনের সেটিও নেই!
উপায় তাই একটাই-এশিয়ান গেমস! ফুটবল ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দেওয়ার শঙ্কা, সামরিক বাহিনীতে হাড় ভাঙা পরিশ্রমের ভয়…সোনা জিততে সন যে সর্বস্ব বাজি রেখে লড়বেন, এটি তো আর বলার দরকার পড়ছে না। ‘হয় সোনা, নয় সেনা’-এই সমীকরণ মেলানোর পথে আজই যাত্রা শুরু হচ্ছে সনের। গ্রুপে প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিপক্ষ বাহরাইন। গ্রুপের বাকি দুই দল কিরগিস্তান ও মালয়েশিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার গ্রুপ পর্ব পেরোনো নিয়ে তাই সংশয় নেই বললেই চলে। আসল পরীক্ষাটা হয়তো শুরু হবে এরপরই। সন হিউং-মিন হয়তো সংশোধনী দিয়ে বলবেন-শুধু পরীক্ষা নয়, অগ্নিপরীক্ষা!
সৌজন্যে- প্রথম আলো