Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সিঙ্গাপুর কতগুলো ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে। পুলাও উবিন হল দ্বীপগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই দ্বীপটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এখানে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার বাস করে।

গত একবছর যাবত পরিকল্পনা করছি এই দ্বীপে একরাত জ্যোৎস্না উপভোগ করব। কিন্তু কর্মব্যস্ততার কারনে যাওয়া হচ্ছে না। গত বুধবার সুমন ভাই হঠাৎ বলল, আগামীকাল জ্যোৎস্না রাত, আসুন আগামীকাল আমরা পুলাও উবিন দ্বীপে জ্যোৎস্না উপভোগ করে আসি। তার প্রস্তাবে না করতে পারলাম না। তারপরদিন অফিস শেষে আমরা চারজন পুলাও উবিনের উদ্দ্যেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম।

chardike-ad

চাংগি ভিলেজ ফেরি ঘাট পৌঁছি পৌনে সাতটায়। আমাদের দূর্ভাগ্য তখন কোন ফেরি পুলাও উবিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে না।আমরা পৌঁছাবার পূর্বেই শেষ ফেরি পুলাও উবিনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। সেখানে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মীরা জানাল আজ আর ফেরি দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাবে না। তার কথা শুনে চারজন প্রচন্ড মন খারাপ করলাম। সুমন ভাই নিরাপত্তাকর্মীদের বুঝালেন আজকের রাত আমরা দ্বীপে থাকব এবং জ্যোৎস্না উপভোগ করব। নিরাপত্তাকর্মী বলল, ঠিক আছে আপনারা তাহলে বার’জন যাত্রীর ভাড়া পরিশোধ করে রিজার্ভ করে ফেরি নিয়ে যান।

তার কথা শুনে আমরা আশার আলো দেখতে পেলাম, চারজন একসাথে বলে উঠলাম, আমরা তাই যাব। আমাদের লক্ষ্য আজ পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না উপভোগ করা। আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুন বেশী ভাড়া পরিশোধ করে দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ফেরি থেকে নেমে অবাক হয়ে গেলাম। এটা যে সিঙ্গাপুরের অংশ তা বুঝার জোঁ নেই। এখানে আধুনিকতার ছোয়া লাগেনি, নাকি ইচ্ছে করেই সরকার এটাকে চিরচেনা গ্রাম্য রুপে সাজিয়েছে তা বুঝতে পারলাম না। ছোট ছোট কয়েকটি ঘর দেখতে পেলাম। ঘরগুলির সামনে সাইকেল পার্ক করা। রাস্তাঘাটে কোন স্টিট ল্যাম্প নেই। নক্ষত্ররাজির আলোয় আমরা পথ চলছি।

পুলিশ ষ্টেশনে একটি বাতি জ্বলতে দেখে এগিয়ে গেলাম। এখানে রাত্রী যাপন করতে হলে পুলিশ ষ্টেশনে রিপোর্ট করতে হয়। পুলিশ আমাদের মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলল, কোন সমস্যা হলে এই নাম্বারে কল দিবেন আমরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসব। পুলিশকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম।

পুলাও উবিনের সামনে বন্ধুদের সাথে লেখক

আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সামনে গিয়ে একটি দোকান খোলা পেলাম। দোকানে বৃদ্ধ দম্পতি বসে আছেন। আমাদের দেখে দু’জন সরল হাসি হেসে দিলেন। হাসির মানে হল স্বাগতম আমাদের দ্বীপে। আমরা তাদের সাহায্যে চারজন চারটি সাইকেল সারারাতের জন্য ভাড়া নিয়ে বের হয়ে গেলাম।

আকাশে মেঘ জমেছে। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে যাওয়ায় চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। সুমন ভাই আর ইমরান ভাইয়ের টর্চ লাইটের ক্ষীন আলোয় চারজন মানব সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি। মাটির সোঁদা গন্ধ আর গাছগাছালির এক অদ্ভুত গন্ধ আমাদের মোহিত করল। দুই পাশে বনাঞ্চল তার মাঝখানে সরু রাস্তা বেয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া যে কতটা আনন্দদায়ক তা আজ এখানে না এলে উপলব্ধি করতে পারতাম না।

জনহীন, বিস্তীর্ণ বনপ্রান্তরে আমরা চারজন প্রানী এগিয়ে চলেছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। শুন্য চারপাশ বন্য-প্রকৃতির কোথাও মানুষ নাই। ভেবেছিলাম ভয়ংকর জীবজন্তু দেখব কিন্তু কোন জীবজন্তু দেখতে পেলাম না। সব হয়ত আমাদের আগমন টের পেয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে কিংবা তাদের রাজ্যে আমাদের সুস্বাগতম জানাচ্ছে।

নি:শব্দ, ভয়ানক নীরব চারদিকে চেয়ে প্রকৃতির এই বিজন রুপালীর মধ্যে ডুবে গেলাম। আস্তে আস্তে মেঘ সরে আকাশে পূর্ন চাঁদ হেসে উঠল। চাঁদ দেখে সবার মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল।চারদিকে আস্তে আস্তে জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে পড়ছে। বনের মাঝে অপরুপ জ্যোৎস্না দেখে মনে হল এ যেন অজানা ও অদ্ভুত সৌন্দর্যময় পরীরাজ্যের মধ্যে দিয়ে চলতেছি, কি অদ্ভুত শান্তি!প্রকৃতির এই আয়োজন বুঝি শুধু আমাদের জন্য।

প্রকৃতির এই রহস্যময় অসীমতার, বিরাটত্বের ও ভয়াল গা ছম-ছম করানো সৌন্দর্যটা আজ আমরা উপভোগ করছি। আজকে প্রকৃতির এই রুপ আমার সারা মনকে এক অসীম রহস্যানুভূতিতে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। কখনো কখনো ভয় আমাদের আচ্ছন্ন করেছে, মনে হয়েছে এই বুঝি কোন বন্য প্রানী এসে আক্রমন করল, এই বুঝি দেখব বিশাল অজগর পথ আগলে শুয়ে আছে।

সুমন ভাই হঠাৎ সাইকেল থেকে নেমে একটি টাওয়ার দেখিয়ে বললেন, এটাই ভিসিটর টাওয়ার এর উপর থেকে পুরো বন আর সমুদ্র দেখতে অসাধারণ লাগে। তার নির্দেশ মত আমরা সাইকেল থেকে নেমে এক পাশে পার্ক করে নিজেদের মালামাল নিয়ে সিড়ে ভেঙে টাওয়ারের চূড়ায় উঠে গেলাম।

টাওয়ারের শীর্ষে আহরণ করে চারপাশের সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।আহা!এত সুন্দর আমাদের প্রকৃতি। প্রকৃতির এই মোহিনীরুপই বুঝি মানুষকে ঘরছাড়া করে। বৃদ্ধদেব নববিবাহিতা তরুনী পত্নীকে ছেড়ে যে রাত্রে গোপনে গৃহত্যাগ করেন যেই রাত্রী বুঝি আজকের মতই সুন্দর ছিল।

আস্তে আস্তে রাত বেড়ে চলেছে আর জ্যোৎস্নাও তার সৌন্দর্য অকৃপণ হাতে বিলিয়ে দিতে লাগল। প্রকৃতির এই অপার কৃপায় আমার মানবজনম ধন্য মনে হচ্ছে।

ভিসিটর টাওয়ারের চারকোনায় চারজন দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করছি কারো মুখে কোন কথা নেই। মনে হচ্ছে কথা বললেই সব সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। নীরবতা ভেঙ্গে সুমন ভাই বললেন,প্রকৃতি আজ আমাদের যা দান করলো তা অতি অমূল্য দান। সবাই প্রকৃতির এই দান উপভোগ করতে পারে না।

আবারো এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। এ যেন পৃথিবী হতে জনহীন কোনো অচেনা গ্রহে আমরা নির্বাসিত হয়েছি। আমাদের নিচে বৃক্ষরাজি আর উপরে সীমাহীন আকাশ। কান পেতে এক ধরনের পতঙ্গের একঘেয়ে একটানা কি-র-র-র শব্দ শুনতে পেলাম।এত অদ্ভুত এই জীবন!

আমি আকরাম, ইমরান ভাই মোবাইল হাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ছবি তোলার জন্য। আমাদের চেষ্টা এই সৌন্দর্যকে বন্দী করে রাখা। সুমন ভাই বললেন, ছবি তুলে কি লাভ? এই ছবি একসময় শত শত ছবির ভিড়ে হারিয়ে যাবে, তারচেয়ে ভাল প্রকৃতিকে উপভোগ করুন। প্রকৃতির সাথে মিশতে চেষ্টা করুন। প্রকৃতির সাথে নিবিড় পরিচয়ের সে কি আনন্দ!

প্রকৃতির সাথে মিল রেখে সুমন ভাই অসাধারণ মিউজিকের সাথে কবিতা ছেড়ে দিলেন। “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথ। “মিউজিকের তালে তালে কবিতা শুনতে শুনতে কখন যে ঘুম আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল তা টের পেলাম না। আমার উপর কে যেন পানি ছিটিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন। চোখ খুলে মনে হল চাঁদ আমার দিকে ছুটে আসছে। হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁতে পারব। জ্যোৎস্না ফুটফুট করছে, গাছের পাতাগুলো অপরুপ সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে। বন্যফুলের সুবাসে জ্যোৎস্নাশুভ্র প্রান্তর ভরপুর।

কি অদ্ভুত শান্তি লাগছে তা বর্ণনা করা অসম্ভব। দূর্বলচিত্তের মানুষের এমন সৌন্দর্য উপভোগ না করাই ভাল। তারা হয়ত পাগল হয়ে যাবে নয়তো গৃহত্যাগ করে বনপ্রান্তরে ঘুরে বেড়াবে।

আমি জীবনে সবসময় উন্নতি করতে চেয়েছি, বাড়ি গাড়ি করতে চাই। কোনদিনও আনন্দ চাইনি। তাইতো আমার জীবন একঘেয়েমিতে ভরে উঠেছে। আজকের রাতে যে আনন্দ পেলাম সারাজীবন আমাকে আনন্দের সাগরে বয়ে নিয়ে বেড়াবে।

রাতে জ্যোৎস্না উপভোগ

রাত্রীর শেষ প্রহরে চারজন বের হলাম প্রকৃতি আরো কাছ থেকে দেখার জন্য। ভিসিটর টাওয়ার থেকে নেমে কাঠের ব্রিজ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। প্রকৃতির এক অপরুপ গন্ধ নাকে এসে লাগতেই মাধকতায় হারিয়ে গেলাম। এক দল শুকর খাবারের সন্ধ্যানে বের হয়েছিল আমাদের উপস্থিত টের পেয়ে জীবনের মায়ায় ছুটে চলল বনের দিকে। শ্যাতশ্যাতে ভেজা মাটিতে বুদ বুদ শব্দে সবাই থমকে দাঁড়ালাম। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলাম কিসের শব্দ কিন্তু বুঝতে পারলাম না।

সমুদ্রের কাছাকাছি এলে ঝিরঝির বাতাসে মন প্রান ঝুরিয়ে গেল। সমুদ্রের পাড়ের হু-হু হাওয়া সবমিলিয়ে আজকের রাতকে মনে হচ্ছে সুখ স্বপ্ন! সবকিছু যেন আনন্দের ঘন নেশা। আমি যেন প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার। আমি মুক্ত গতিতে সময়ের সীমা পার হয়ে চলেছি। এই চলা যেন আমার সৌভাগ্য, এ যেন আমার প্রতি প্রকৃতির আর্শিবাদ। এখান থেকে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।

তবুও বাস্তবতা মেনে আমরা চারজন ফিরে চললাম প্রতিদিনের মত গতানুগতিক জীবনে। সকালের বনরাজি অন্য আরেক রুপে সেজেছে। গাছের পাতা ঠিকরে সকালের সূর্যরশ্মি বনের ভেতর এক অপরুপ কারুকার্য সৃষ্টি করেছে। একঝাক মন মুরগী আহার সংগ্রহ করছিল আমাদের দেখে রুদ্ধশ্বাসে পালাল।
একদল পরিচ্ছন্ন কর্মী রাস্তার শুকনো পাতা পরিষ্কার করে পথচারীদের চলার পথ সুগম করছে। একজন ইউরোপিয়ান সকালের প্রকৃতি ক্যামেরাবন্দী করছেন। এযেন এক স্বপ্নের সমাপ্তি।

আজকে উপলব্ধি করলাম, প্রকৃতি যা দেয় উজার করেই দেয়। তার দানে কোন কার্পণ্য থাকে না।

এম ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর প্রবাসী।