Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

south-korea

বিশ্বকাপে এক সময় এশিয়া থেকে অংশ নেয়ার জন্য কোনো কোটা ছিল না। ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকানরা মনে করে এশিয়ানদের অংশগ্রহণ মানেই সেই টুর্নামেন্ট ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাওয়া। এমনকি এশিয়ায় বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়েও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার আর মিশেল প্লাতিনিরা নাক ছিটকেছেন পর্যন্ত। বলে বেরিয়েছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ হবে এশিয়ায়। এমনকি আফ্রিকায় বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়েও নাক ছিটকেছিলেন তারা।

chardike-ad

কিন্তু ইউরোপীয়রা যতই এশিয়াকে পেছনে ফেলে রাখার চেষ্টা করুক, এশিয়ান দেশগুলো বারবার ইউরোপের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তারা কতটা যোগ্য। সর্বশেষ এই কাজটা করে দেখিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এবার রাশিয়া বিশ্বকাপেই। এফ গ্রুপ থেকে আগেই কোরিয়ানদের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু যে দলটির স্লোগানই হচ্ছে, ‘হিরোজ নেভার রেস্ট’, যারা বিশ্বকাপে খেলতেই আসে অন্তত সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে, সেই জার্মানির বিপক্ষে শেষ ম্যাচে মুখোমুকি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া বুঝিয়ে দিয়েছে, তারাও ‘কখনও বিশ্রাম নেয় না’। সুতরাং, কাজান এরেনায় দেখা গেলো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন, টপ ফেবারিট জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে কোরিয়ানরা। নিজেরা তো বিদায় নিয়েছেই। সঙ্গে বিদায় করলো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের। আর বিশ্বকে দেখিয়ে দিল, এশিয়ার দল মানেই ফেলনা নয়।

ইতিহাস এবং পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিত্ব করা অষ্ট্রেলিয়াকে ধরে এখন পর্যন্ত ফিফা বিশ্বকাপে এশিয়ার ১২ দল এখন পর্যন্ত অন্তত একবার করে বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশ নিয়েছে। সর্বাধিক ১০ বার (১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৯০, ১৯৯৪, ১৯৯৮, ২০০২, ২০০৬, ২০১০, ২০১৪, ২০১৮) মূল পর্বে প্রতিনিধিত্ব করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।

দক্ষিণ কোরিয়ার সেরা ফল, অর্জন ও কৃতিত্ব; ২০০২ সালে সেমিফাইনাল এবং চতুর্থ স্থান পাওয়া। যা শুধু দক্ষিণ কোরিয়ারই নয়, এখন পর্যন্ত কোন এশিয়ার কোন দলের সেরা সাফল্য।

দক্ষিণ কোরিয়া, ২০০২ সালে ঘরের মাঠে গ্রুপ পর্বে দারুণ ফুটবল খেলে শুরুতেই চমক দেখায় পোল্যান্ডকে ২-০ গোলে হারিয়ে। পরের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। শেষ ম্যাচে কোরিয়ানদের উদ্যমী আর গতিময় ফুটবলের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় পর্তুগালও।

পর্তুগিজদের ১-০ গোলে হারিয়ে সেরা ষোলোয় নাম লেখায় কোরিয়ানরা। দ্বিতীয় পর্বে দক্ষিণ কোরিয়ার দাপটের সামনে দাঁড়াতে পারেনি ইতালির মত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরাও। আজ্জুরিদের ২-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যায় কোরিয়া। শেষ আটের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ স্পেন। নির্ধারিত ৯০ এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিটসহ ১২০ মিনিট প্রবল লড়াইয়ে গোলশূন্য অবস্থায় শেষ করার পর টাইব্রেকারে ৫-৩ ব্যবধানে স্প্যানিশদের হারিয়ে পৌঁছে যায় শেষ চারে।

জার্মানদের সাথে সেমির লড়াইয়ে অবশ্য আর পারেনি। ১-০ গোলে হেরে যায়। পরে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান নির্ধারনী ম্যাচে তুরষ্কার কাছে হারে ২-৩ গোলে। ফলে চার নম্বর হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় দক্ষিণ কোরিয়াকে।

সর্বাধিক ১০বার অংশগ্রহণই শেষ কথা নয়। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বকাপের মূল পর্বে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জেতার রেকর্ডটিও দক্ষিণ কোরিয়ার (৩৪ ম্যাচে ৬ জয়, ৯ ড্র আর ১৯ পরাজয়)। তবে সংখ্যাতত্ত্বে জাপানের সাফল্য আনুপাতিক বেশি। দক্ষিণ কোরিয়া যেখানে ৩৪ ম্যাচের ৬টিতে জিতেছে, সেখানে জাপানিজরা ১৯ ম্যাচে জিতেছে পাঁচটিতে। ড্র’ও করেছে সমান পাঁচ ম্যাচ। আর হেরেছেও তুলনামূলক কম; ৯টিতে।

এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত তৃতীয় সর্বাধিক তিন জয় সৌদি আরবের। পাঁচবার খেলতে গিয়ে ১৬ ম্যাচে অংশ নিয়ে তিনটিতে জিতেছে সৌদিরা। আর হেরেছে ১১ টিতে। ড্র করেছে মাত্র দুটি ম্যাচ। জয়ের সংখ্যা বা সাফল্যের মানদন্ডে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইরানের অবস্থান চতুর্থ। ইরানিরা এখন পর্যন্ত পাঁচবার মূল পর্বে খেলে ১৫ ম্যাচের মধ্যে জিতেছে কেবল ২টিতে। হেরেছে ৯ ম্যাচ। ড্র করেছে ২টিতে।

কাকতালীয়ভাবে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেরা ফল আরেক কোরিয়ার। মানে উত্তর কোরিয়ার। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডে বসা আসরে ইতালির মত বড় দলকে টপকে শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। সেখানে ইউসেবিরও’র অসাধারণ নৈপুণ্যের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ৫-৩ গোলে পরাজিত হয় তারা।

দক্ষিণ কোরিয়ার পর এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে এছাড়া দ্বিতীয় সর্বাধিক ছয়বার বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশ নেয়ার কৃতিত্ব জাপানের। সুর্যোদয়ের দেশটি প্রথম বিশ্বকাপে নাম লেখায় ১৯৯৮ সালে। ফ্রান্সে হওয়া বিশ্বকাপের ১৬ নম্বর আসরে প্রথমবার অংশ নেয়া জাপান। এরপর থেকে বিশ্বকাপের মূল পর্বের নিয়মিত প্রতিযোগি হয়ে গেছে তারা। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০২, ২০০৬, ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৮-তে টানা ছয়বার বিশ্বকাপ খেললো জাপানিরা।

তবে এই ছয়বারের অংশগ্রহণে দলটির এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য ২০০২ সালে। সেবার দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক ছিল জাপান। নিজ মাটিতে বিশ্বকাপের সেরা ষোলোয় পৌঁছায় তারা। গ্রুপ পর্বে বেলজিয়ামের সাথে ২-২ গোলে ড্র দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেবার। এরপর এশিয়ার দলটি ১-০ গোলে হারায় রাশিয়াকে। আর শেষ ম্যাচে তিউনিসিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় পর্বের টিকেট নিশ্চিত করে। সেরা ষোলোয় গিয়ে অবশ্য আর কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তুরস্কের কাছে ১-০ গোলে হারে শেষ হয় জাপানের বিশ্বকাপ যাত্রা।

এবারও জাপানের শুরুটা দারুণ। কলম্বিয়ার মত দলকে হারিয়ে শুরু করেছে। এই প্রথম কোনো লাতিন দেশকে হারানোর কৃতিত্ব দেখালো এশিয়ার কোনো দেশ। দেখা যাক ১৬ বছর পর জাপান আবার দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছাতে পারে কি না?

এছাড়া এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে আরও একটি দল একবার প্রথম রাউন্ডের প্রাচীর টপকে দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রাখে। সে দলটির নাম সৌাদ আরব। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রর মাটিতে সেরা ষোলোয় পৌঁছে যায় সৌদিরা। সেবার তাদের শুরুটা তেমন ভাল হয়নি। যাত্রা শুরু হয় নেদারল্যান্ডসের কাছে ২-১ গোলে হার দিয়ে।

এরপর মরক্কো আর বেলজিয়ামের বিপক্ষে পরের দুই ম্যাচে জয়। সৌদির গতিময় ফুটবলের কাছে ২-১ গোলে হার মানে আফ্রিকার মরক্কো। আর ইউরোপের দল বেলজিয়াম পরাজিত হয় ১-০ গোলে। হার দিয়ে শুরুর পরও গ্রুপের পরের দুই ম্যাচ জিতে দ্বিতীয় পর্বে পা রাখে সৌদি আরব। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সৌদির সেটাই সেরা সাফল্য। তবে দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে আর কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। সুইডেনের কাছে ৩-১ গোলে হেরে বিদায় নেয় তারা।

এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের প্রাচীর টপকানো সম্ভব না হলেও, বেশ ভাল ফুটবল খেলেছে সৌাদি আরব। শুরুটা দেখে মনে হয়েছিল, এবার বুঝি সৌাদি আরবের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে পারফরমেন্স হবে। প্রথম দিন মাঠে নেমে স্বাগতিক রাশিয়ার কাছে চরমভাবে পর্যদুস্ত হওয়া। ৫-০ গোলের বিরাট পরাজয়ে অতিবড় সৌদি আরব ভক্তেরও মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আর সমালোচকরা নড়ে চড়ে বসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আরে সৌদি আরব কিচ্ছু পারে না। শুধু অংশ নিতেই বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলতে আসে।’

কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সৌাদিরা পরের দুই ম্যাচে সে ধারণাকে অমূলক ও ভুল প্রমাণ করে ছাড়ে। প্রথম ম্যাচে পাঁচ গোল হজমের ধাক্কা সামলে পরে দুই খেলায় দারুণ খেলে সৌদি আরব। দ্বিতীয় ম্যাচে উরুগুয়ের সাথে প্রায় সমান সমানে লড়ে হার মানে মাত্র ১-০ গোলে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে সৌদি আরব এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দল মিসরকে ২-১ গোলে হারিয়ে রীতিমত হইচই ফেলে দেয় সৌদিরা।

এশিয়ার আরেক সমৃদ্ধ ফুটবল শক্তি ইরানও সৌদি আরবের সমান পাঁচবার বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে। যদিও এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের আরেক দল অস্ট্রেলিয়াও সমান পাঁচবার বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলেছে। তবে মহাদেশ হিসেব করলে, এশিয়া মহাদেশের দলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া (১০ বার), জাপানের (ছয়বার) পর সৌদি আরব (১৯৯৪, ১৯৯৮, ২০০২, ২০০৬ ও ২০১৮) এবং ইরান (১৯৭৮, ১৯৯৮, ২০০৬, ২০১৪ ও ২০১৮) পাঁচবার করে বিশ্বকাপের মূল পর্বে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছে।

কাকতালীয়ভাবে ইরানের দুটি বিশ্বকাপ জয় সবচেয়ে বেশি সময়ের বিরতিতে। ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে ইরান প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ জিতেছিল ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। একমাত্র গোলে যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে রীতিমত সাড়া জাগিয়েছিল ইরানিরা। দুই দশক পর এবার ইরান হারিয়ে দেয় আফ্রিকার আরেক শক্তিশালী দেশ মরক্কোকে। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ইরানের দুর্দান্ত ফুটবল শৈলির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে মরক্কো। যদিও ওই ম্যাচে ইরানের জয় মরক্কোর আত্মঘাতি গোলে।

এছাড়া বর্তমান সময়ের অন্যতম শীর্ষ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দল পর্তুগালের বিপক্ষেও দারুণ ও প্রানবন্তু ফুটবল খেলে ১-১ গোলে ড্র করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে ইরানিরা। এই দল ক’টার বাইরে এশিয়ার আরও সাত দল (উত্তর কোরিয়া, ইসরায়েল, কুয়েত, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত ও চীন) বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। তবে উত্তর কোরিয়া ছাড়া বাকি ছয় দল এখন পর্যন্ত মূল পর্বে গিয়ে জয়ের দেখা পায়নি।

১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে অতিনাটকীয়ভাবে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌছে যাওয়া উত্তর কোরিয়া এখন পর্যন্ত দুইবার (১৯৬৬ ও ২০১০ সালে) অংশ নিয়ে মোট সাতটি ম্যাচ খেলেছে। যার মধ্যে জয় একটি। আর ড্র’ও একটি। দুটি কৃতিত্বই ১৯৬৬ সালে। সেবার গ্রুপের প্রথম ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৩-০ গোলে হারলেও পরের ম্যাচেই চিলির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে বসে উত্তর কোরিয়ানরা। আর গ্রুপের শেষ ম্যাচে দেখায় আরও বড় চমক। তাদের চমকে দেয়া পারফরমেন্সের কাছে ১-০ গোলে হার মানে বিশ্ব ফুটবলের বড় শক্তি ইতালি।

এছাড়া চীন (২০০২), ইন্দোনেশিয়া (১৯৩৮ সালে), ইসরায়েল (১৯৭০), কুয়েত (১৯৮২), ইরাক (১৯৮৬) ও আরব আমিরাত (১৯৯০) একবার করে মূল পর্বে অংশ নিলেও কোন ম্যাচ জিততে পারেনি।