অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সৌন্দর্যের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সমুদ্রসৈকত। প্রকৃতিই তার মূল সৌন্দর্য। পুরো অস্ট্রেলিয়া জুড়ে প্রায় ১০ হাজার ছোট বড় সমুদ্র সৈকত আছে। আমাদের পিকনিকের স্পট হিসেবে আমরা তাই সমুদ্র সৈকতকেই বেছে নিলাম আর খুঁজে খুঁজে বের করলাম খুব জনপ্রিয় আর বড় একটি বিচ। যার নাম নোসা হেড মেইন বিচ। ১৯৮০ সালের পর মূলত পর্যটন, সার্ফিং ও হলিডে উৎযাপনকে কেন্দ্র করে নোসা হেডের পুরো এলাকার তথা বিচ আর লেকের সমন্বয়ে রাস্তাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামোর দ্রুত উন্নতি হয়। নোসা হেড মেইন বিচ কোরাল সি সংলগ্ন কুইন্সল্যান্ডের নোসা হেডে অবস্থিত একটি বিচের নাম। যা রাজধানী ব্রিসবেন থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে।
গত সপ্তাহের রোববারে পিকনিকের উদ্দেশ্যে আমরা গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে পিএইচডি, মাস্টার্স ও অনার্সের ছাত্রছাত্রী ও বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্য সদস্যরা ওখানে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। নিজস্ব ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে আমরা ঠিক করলাম একটি বাস ভাড়া করে ঠিক বাংলাদেশে যেমন পিকনিক করতে যাই সেভাবেই যাব। প্রায় ৬০ জন পিকনিকের উদ্দেশে রওনা হলাম। বাস আমাদের নোসা হেড মেইন বিচের পাশে নামিয়ে দিল।
প্রথমেই আমরা সবাই গেলাম মেইন বিচ তথা সমুদ্রসৈকতে। হাজার হাজার পর্যটক সি বিচে সাঁতার কাটছেন, সার্ফিং করছেন, লাফালাফি করছেন, বিভিন্ন খেলা খেলছেন, সান বাথ নিচ্ছেন, কোনো আওয়াজ নেই। মাছের বাজার টাইপ চিৎকার চেঁচামেচি নাই। স্বল্পবসনা নারী-পুরুষ যে যার মতো সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত। কেউ কারও দিকে তাকানোর সময়ও নেই। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমাদের মতো ঝগড়াও নেই। পাশেই সুইমিং পুল। স্বচ্ছ পানিতে ছেলেপুলেসহ পরিবারের সবাই সাঁতার কাটছে। খুব মজার। কেউ কোথাও কাউকে বিরক্ত করছে না। বা বিরক্ত হচ্ছে না। পাশের ড্রেস চেঞ্জিং কক্ষে বা টয়লেটে হাজার লোক যাচ্ছে। টয়লেটে কোনো অযাচিত ময়লা বা নোংরা পরিবেশ তৈরি করছে না।
কৃত্রিম ঝরনায় গোসলও খুব ফান! বাচ্চাদের জন্য ছোট খাটো রাইড, বয়স্কদের জন্য শরীরচর্চার সরঞ্জাম। কী নেই? একটু দূরেই সমুদ্রে নামার জন্য সারিবদ্ধ সিঁড়ি এবং গোসলের জন্য ঝরনাকল পয়েন্ট ও পোশাক পরিবর্তনের জায়গা। না দেখলে বিশ্বাসই হয় না প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক সরঞ্জামাদির কী সুন্দর সংযোগ ও সমন্বয়। মিলেমিশে একাকার। পর্যটকেরা যত প্রয়োজন অনুভব করতে পারে সব আছে ওখানে। আমাদের ট্রলি ব্যাগ এক জায়গায় রেখে কত জায়গায় গেলাম। কোনো চোর এসে সেটা নিয়ে যায়নি। আহা এমন যদি বাংলাদেশে হতো! নিশ্চয়ই বিচের সব দেখে আমার কেবলই মনে হলো প্রাকৃতিকভাবে আমাদের কক্সবাজার অনেক সুন্দর। এর ধারে কাছে অন্য বিচ আসবে না। অন্তত আমার চোখে তাই মনে হয়েছে। তবে অন্যান্য সুবিধা, অবকাঠামো, মানুষের ব্যবহার, আচরণ, গতিবিধি, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনায় আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। দরকার উন্নত অবকাঠামো এবং নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণ ও রুচিশীল ব্যবহার।
এরপরেই আমরা সবাই মধ্যাহ্নভোজনে যোগদান করলাম। বাঙালিদের এ পিকনিকের পুরো রান্নাটি সম্পন্ন করেছেন বাঙালি কায়দায়, বাঙালি রুচি ও স্বাদে আমাদের সকলের প্রিয় বাবুর্চি রাজু ভাই। বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকি, তাই বাংলাদেশি খাবার আমরা ছাত্রছাত্রীরা যারা একা থাকি তারা খুব মিস করি। সুস্বাদু খাবার খেয়ে বনভোজনের পূর্ণ স্বাদ পেলাম। সাধারণত এখানে সবাইকে নিজের রান্না নিজেকেই করে খেতে হয়। কোথাও গেলেও রান্না করে নিয়ে যেতে হয়। যাকে বলে পটলাক লাঞ্চ। নিজের হাতের খাবার খেতে খেতে অনেক সময় আমরা হাঁপিয়ে উঠি। তাই পিকনিকের আনন্দের সঙ্গে বাঙালি স্বাদের এ বনভোজন সত্যিই অতুলনীয়। খাবারের এ স্বাদ দেশ, মা ও মাটিকে মনে করে দেয়।
ভোজন পর্ব শেষে খেলাধুলার আয়োজন ছিল সবচেয়ে মনকাড়া। ভাই-ভাবি ও আপুদের ইভেন্টতো ছিলই, ছিল বাচ্চাদের জন্যও মনমাতানো আয়োজন। যদিও প্রবাসে এ খেলা তবুও সেখানে রাখা দেশীয় আমেজের সব দেশীয় খেলা। এসবের মধ্যেই আমরা বিদেশে বসে দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি উপভোগ করেছি এবং বাচ্চাদের মধ্যেও তা সঞ্চারণের প্রচেষ্টা ছিল। ভাবি-আপাদের চোখ বাঁধা অবস্থায় দূর থেকে গিয়ে নায়িকা পূর্ণিমার শাড়িপরা ছবিটির কপালে সঠিক স্থানে টিপ পরানোর গেমটি ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মজার। ক্রীড়ানুষ্ঠান ও লটারি চলাকালে স্বভাবসুলভভাবেই চলেছে ইয়ার্কি, ঠাট্টা, টিকা-টিপ্পনীর নানা কথাবার্তার খেলা আর হাসি তামাশা। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করা হয়েছে সকল বিজয়ীর মাঝে।
সবশেষে আমরা গেলাম লেগোনা লুকআউটে, যেখান থেকে পুরো নোসা হেড এলাকা দেখা যায়। সেখানে আয়োজন ছিল ঝাল-মুড়ি খাওয়ার। মুড়ি-কাঁচামরিচ-ধনেপাতা-পেঁয়াজ-সরিষার তৈল দিয়ে মাখিয়ে সবাই যখন খাচ্ছিল মনে হচ্ছিল অমৃত! পরে চা খাওয়া আর সূর্যাস্ত উপভোগ। একই সঙ্গে আমরা একটি ছোট্ট বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদায় দিলাম সদ্য পিএইচডি সম্পন্ন করা নাজমুল ইসলাম শিপলু ভাই ও এহসান ভাইকে।
এভাবে একটা দিন আমরা ঠিক বাংলাদেশি আমেজে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার সময় চালক মাইক তাঁর গাড়ি নিয়ে হাজির হওয়ায় যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজ ঠিকানার উদ্দেশে ফিরতি যাত্রা করলাম। এই দূর পরবাসে প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা আর ক্লান্তির সীমানা পেরিয়ে একটি অন্যরকম দিন কাটানোর আনন্দে এই দিনটি আমাদের সকলের মনেই স্থান করে নেবে। হয়তো বা ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণার এক উপলক্ষ হিসেবে রয়ে যাবে আমাদের হৃদয়ে। পিকনিকে অংশগ্রহণ করায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সফিকুল ইসলাম, সহসভাপতি রিপন কুমার মণ্ডল, সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ মারজিয়া বিলকিস।
লিখেছেন: সফিকুল ইসলাম, পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সায়েন্স, গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: shafiqul.islam@griffithuni.edu.au
সৌজন্যে: প্রথম আলো