সব সময়ের যুদ্ধংদেহী অবস্থান থেকে সরে এসে কূটনীতির রাস্তায় চলতে শুরু করা উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনকে আপাতত সফল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ সাফল্যের সর্বশেষ অর্জন হিসেবে তিনি আগামী ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন। কিমের এ সাফল্যে ট্রাম্পের ভূমিকাও কম নয় বলে অভিমত তাঁদের।
একটা সময় পর্যন্ত নিজেকে বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন কিম। পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সর্বশেষ অগ্রগতির খবর ছাড়া আর কিছুই তিনি জানাতেন না। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি ঘোষণা দিলেন, তাঁর পরমাণু কার্যক্রম পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের যেকোনো জায়গায় পারমাণবিক হামলা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে তাঁর দেশ। এ ঘোষণার পর থেকে তাঁর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু এবং সেটা তিনি শুরু করেন বেশ জোরেশোরে।
শুরুতেই কিম সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেননি। তিনি বরং ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। সীমানা প্রতিবেশী এবং যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ায় পা দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের দূতিয়ালি আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টিতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। ট্রাম্প-উন আসন্ন বৈঠক আয়োজনে তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ কোরিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক কু কাব উয়ো বলেন, পেইচিং ও সিউল হয়ে উন ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। একটি ছোট রাষ্ট্রের পক্ষে কূটনীতির পাল্লা ভারী করার জন্য এটাই সবচেয়ে কার্যকর রাস্তা।
দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতামূলক ভূমিকার মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান আরো সুসংহত করতে চীন সফর করেন উন। এর মধ্য দিয়ে পুরনো মিত্র চীনের সঙ্গে খানিকটা আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্ক ঝালিয়ে নেন তিনি। উয়োর মতে, পেইচিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় করাটা উনের ‘ভারসাম্যমূলক রাজনীতির সর্বোত্তম এক উদাহরণ’। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (সিআইএ) উত্তর কোরিয়া বিষয়ক সাবেক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা এবং বর্তমানে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের অধ্যাপক জুং পাক বলেন, আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলিয়ে নিতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন উন। জুং পাক আরো বলেন, উনের দৃষ্টিতে চীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্যতম এক শক্তি (এবং সম্ভবত একটা ইনস্যুরেন্স পলিসি)।
সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও খেলেছেন উন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার আগ্রহ প্রমাণ করতে তিনি আপাতত আর কোনো পরমাণু পরীক্ষা না চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন, উত্তর কোরিয়ায় আটক তিন মার্কিন বন্দিকে মুক্তি দিয়েছেন, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত এবং আপাতদৃষ্টিতে নিজেদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পুঙ্গি রি পরমাণু পরীক্ষাকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে আগামী ১২ জুন ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক চূড়ান্ত করেছেন এই উত্তর কোরীয় নেতা।
সিঙ্গাপুরে বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব ট্রাম্পকেও দিতে চান পর্যবেক্ষকরা। এ ধরনের একটি বৈঠকের প্রস্তাব নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিরা ট্রাম্পের কাছে গেলে তিনি কারো সঙ্গে পরামর্শ না করেই তাতে মত দিয়ে দেন। বাগিবতণ্ডার জেরে গত ২৪ মে তিনি বৈঠক বাতিল করলেও দ্রুতই আবার ইতিবাচক মনোভাব জানান। বৈঠক চূড়ান্ত হওয়ার কৃতিত্ব ট্রাম্পের পাশাপাশি মুনেরও প্রাপ্য বলে মনে করেন উয়ো। তিনি বলেন, ‘মুন জায়ে ইন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং উনের সম্মিলন না হলে এ বৈঠক হওয়া অসম্ভব ছিল।’
বৈঠকের ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে বটে, তবে আসান ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের বিশ্লেষক গো মাইয়ং হাইয়ুন মনে করেন, সিঙ্গাপুরের বৈঠক ব্যর্থ হলে উন তত্ক্ষণাৎ পরমাণু কর্মসূচিতে ফেরত না গিয়ে চলমান কূটনীতি বজায় রাখবেন। ফলে তাঁর সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে পেইচিং ও সিউলের সহযোগিতার সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।
সূত্র : এএফপি।