এমবিএ পড়তে কানাডা যাওয়ার জন্য রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) আবেদন করেছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম। গত এপ্রিলে সরবরাহের কথা থাকলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত পাসপোর্ট হাতে পাননি তিনি। আগামী সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্টসহ কাগজপত্র জমা দিতে না পারলে তার কানাডা যাওয়া হবে না বলে জানান এ শিক্ষার্থী।
শুধু ইফতেখারুল ইসলাম নন, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় আছেন তার মতো আরো অনেকেই। এদের কেউ শিক্ষার্থী, কেউ জটিল রোগে চিকিৎসার জন্য, কেউবা ব্যবসায়িক প্রয়োজন বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমনের লক্ষ্যে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী, সাধারণ আবেদনকারীকে পুলিশ প্রতিবেদন পাওয়ার ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে এবং জরুরি আবেদনকারীকে পুলিশ প্রতিবেদন পাওয়ার ৭ কর্মদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট প্রদান করার কথা। অথচ নির্ধারিত এ সময় পেরিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে আবেদনকারীদের।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পেন্ডিং পাসপোর্টের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। কিন্তু এক মাসের ব্যবধানে এপ্রিলে সেই সংখ্যা এক লাখে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে দুই লাখের কাছাকাছি আবেদনকারী পাসপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছেন। এছাড়াও সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের প্রবাসীদের আট লাখ পাসপোর্টের চাহিদা রয়েছে।
দেশের সব পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ছে। এসব আবেদন গ্রহণের সময় ডেলিভারি স্লিপে লিখে দেয়া হচ্ছে পাসপোর্ট প্রদানের সম্ভাব্য দিন। যদিও নির্ধারিত সময়ের পর দু-তিন মাস ঘুরেও মিলছে না পাসপোর্ট।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত বুকলেট (পাসপোর্ট তৈরির কাগজ) সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চাহিদা অনুযায়ী পাসপোর্ট বই ছাপানো সম্ভব হচ্ছে না।
পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট প্রকল্প সামনে রেখে চলতি বছর মাত্র ২২ লাখ পিস বুকলেট আমদানি করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে এরই মধ্যে ৩০ লাখের বেশি পাসপোর্ট আবেদন ফরম জমা নেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রবাসীদের চাহিদা রয়েছে আরো আট লাখ এমআরপির। জরুরিভিত্তিতে প্রবাসীদের পাসপোর্টগুলো দেয়া না হলে বিদেশে তারা অবৈধ ঘোষিত হতে পারেন। এমনটি হলে বড় অংকের রেমিট্যান্স হারাবে সরকার। তাই এ ধরনের সংকট এড়াতে যুক্তরাজ্য থেকে ৫০ লাখ বুকলেট আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মূল ভবনের নিচতলায় রয়েছে একটি নিজস্ব ছাপাখানা। সেখানকার এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন দেশে বুকলেটের চাহিদা প্রায় ২০ হাজার। কিন্তু ছাপাখানার মেশিনের যান্ত্রিক ত্রুটি ও বুকলেট সংকটের কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিন বই ছাপানো হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন ছয় থেকে আট হাজার পেন্ডিং থেকে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবাসীদের আট লাখ নতুন পাসপোর্টের আবেদন।
সরেজমিন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, পাসপোর্ট প্রদানের বিলম্বের সুযোগটি নিচ্ছেন এক শ্রেণীর দালাল চক্র। একদিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাইয়ে দেয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে তারা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্ধারিত সময়ের এক মাসেরও বেশি সময় ঘুরেও তারা পাসপোর্ট পাননি। কিন্তু দালালকে অতিরিক্ত ১ হাজার টাকা দিলেই একদিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে এ পথেই হাঁটতে হচ্ছে।
সম্প্রতি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ডেলিভারি শাখায় গিয়ে অসুস্থ বাবার পাসপোর্ট সংগ্রহের জন্য ধরনা দিচ্ছেন হারুন অর রশিদ নামে এক যুবক। তিনি জানান, তার বাবা স্পাইনাল কর্ডের সমস্যায় ভুগছেন। তাকে ভেলোরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য জরুরিভাবে পাসপোর্টের আবেদন করেছেন। এ পাসপোর্ট প্রদানের সম্ভাব্য দিন ছিল ২৮ এপ্রিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের এক মাস অতিক্রম হলেও এখনো পাসপোর্ট নামের সোনার হরিণের দেখা পাননি হারুন।
ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, সাধারণভাবে পাসপোর্ট করতে দিলে বিলম্ব হয়। তাই বিলম্ব এড়াতেই অতিরিক্ত ফি দিয়ে জরুরি পাসপোর্টের আবেদন করেছি। কিন্তু জরুরি পাসপোর্ট দিতেও যদি দুই মাস লাগে, তাহলে অতিরিক্ত ফি দিয়ে লাভ কী?
পাসপোর্ট প্রদানে বিলম্বের কারণ জানতে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাসুদ রেজওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। যদিও এর আগে এক সভায় অতিরিক্ত পাসপোর্টের চাপ এবং মেশিনের কর্মক্ষমতা কমে আসায় পাসপোর্ট প্রদানে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
বণিকবার্তার সৌজন্যে।