যুগ যুগ ধরে রাজা, বাদশা, আমির, ফকির নির্বিশেষে বাঙালিরা হাত দিয়েই খাবার খেয়েছে। তবে তখনও চামচ বস্তুটি ছিল। তা অন্য কাজে ব্যবহার করা হতো। পরে ইউরোপীয় সংস্কৃতি বাঙালির মধ্যে ঢুকে যায়। ফলে হাত দিয়ে খাবার খাওয়াকে তারা ছোটলোকের কাজ বলে মনে করতে থাকেন।
নিজেকে উঁচু স্থানের মানুষ বানাতে গিয়ে তারা হাত ছেড়ে চামচ দিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করেন। অথচ প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র জানায়, হাত দিয়ে খাবার খাওয়া মোটেই অস্বাস্থ্যকর কিছু নয়। বরং তা দেহের জন্য বিশেষ উপকারী।
খাবারের স্বাদ: বাঙালি যে ধরনের খাবার খান, তা তৈরি করতে হাতের প্রয়োজন। হাত দিয়েই ভাত মেখে খাওয়া সম্ভব। অন্য কোনোভাবে খাবার খেলে তার স্বাদ নষ্ট হয়। যে খাবার খেতে বিস্বাদ লাগে, তা পাকযন্ত্রের উপরে চাপ ফেলে।
হজমের উন্নতি ঘটায়: আপনার হাতের তালু ও আঙ্গুলে ভালো ও খারাপ উভয় ধরনের ব্যাকটেরিয়াই থাকে। ভালো ব্যাকটেরিয়া পরিবেশের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে আপনাকে সুরক্ষা দেয়। চামচ দিয়ে খাওয়ার সময় এই ব্যাকটেরিয়াগুলো আপনার অন্ত্রে প্রবেশ করে না। তাছাড়া আপনি যখন হাত দিয়ে খাবার স্পর্শ করবেন তখন মস্তিস্কে বার্তা পৌঁছায় পরিপাক রস ও এনজাইম নিঃসৃত করার জন্য। খাবারের ধরনের উপর নির্ভর করে আপনার বিপাক পরিচালিত হয় এবং সে অনুযায়ী কাজ করে, যা ভালোভাবে হজমের জন্য প্রয়োজনীয়। সুস্থ দেহ ও মনের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিপাক প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়: চামচ দিয়ে খেলে খাওয়া সহজ ও দ্রুত হয়। কিন্তু এর ফলে রক্তের চিনির মাত্রা বৃদ্ধি পায় বলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ও বৃদ্ধি পায়। ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ এন্ডোক্রাইনোলজিতে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে যে, যারা দ্রুত খান তাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি যারা আস্তে খান তাদের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। তাই বলা যায় যে দ্রুত খাওয়া ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে, এই সমস্যাটি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য হাতে খাওয়া শুরু করতে পারেন। হাতে খেলে সময় লাগে এবং অল্প খাবার মুখে পোরা হয়। ধীরে খাওয়া হজমের উন্নতিতে সাহায্য করে এবং আপনাকে পেট ভরার অনুভূতি দেয়, ফলে কম খাবার খাওয়া হয়।
শরীরচর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ: হাত দিয়ে খাবার খাওয়ার সময় একাধিক পেশির সঞ্চালন হতে থাকে। ফলে হাতের পাশাপাশি সারা শরীরে রক্তের সরবরাহ বেড়ে যায়। আর এমনটা হওয়া মাত্র বিভিন্ন অঙ্গে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তও পৌঁছে যায়। ফলে শরীরের প্রতিটি অংশ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
বেশি স্বাস্থ্যকর: হাত দিয়ে খাওয়াকে অনেকেই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস মনে করেন। কিন্তু আসল ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। যারা হাত দিয়ে খান তারা প্রতিবেলায় খাওয়ার সময় হাত ধুয়ে নেন। তাই হাত দিয়ে খাওয়া অনেকবেশি স্বাস্থ্যকর।
ধ্যানমুদ্রা: খাবার হাত দিয়ে খাওয়ার সময় আঙুল বিভিন্ন মুদ্রায় স্থিত হয়। এই মুদ্রাগুলোর অধিকাংশই যোগ-বর্ণিত ধ্যানমুদ্রা। এতে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার উন্নতি হয়।
সনাতন ধর্ম: বৈদিক মন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘করাগ্রে বসতে লক্ষ্মী’। এই মন্ত্রে হাত দিয়ে খাবার গ্রহণের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। সনাতন ধর্মে বলা হয়, করাঙ্গুলি আমাদের কর্মেন্দ্রিয়। এর স্পর্শে খাবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। খাবার হাত দিয়ে খেলে তা তাদের প্রসাদে পরিণত হয়।
আয়ুর্বেদ: আয়ুর্বেদ মতে, পঞ্চাঙ্গুলি পঞ্চভূতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ব্যোমের, তর্জনি বায়ুর, মধ্যমা অগ্নির, অনামিকা জল ও কনিষ্ঠা মাটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। হাত দিয়ে খাবার খেলে এই পঞ্চভূতও শরীরে প্রবেশ করে।