প্রবাসে অন্যের অধীনে কাজ করি বলে ইফতারটাও ঠিকমতো করা হয় না। সারা দিন রোজা রেখে কর্মস্থানেই সেরে নিতে হয় ইফতার। একদিন সামান্য ছোলা মুড়ি ও সাধ্যানুযায়ী কিছু ফলমূল আর ঠান্ডা পানি নিয়ে ইফতারের আয়োজন করলাম। আয়োজন প্রায় শেষ। পাশের মসজিদের আজানও শোনা যাচ্ছে।
এমন সময় দেখলাম আমাদের মার্কেটের সুপারভাইজার (বাহরাইনি) তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছেন দোতলায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে। আমি তাকে দেখেই ডাক দিলাম। বললাম, আজান হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে ইফতার সেরে নিন।
সুপারভাইজার সবিনয়ে না করে জানালেন, বাসায় তার মা ইফতারি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার সঙ্গে এখানে ইফতারি সেরে নিলে তার মা মনে কষ্ট পাবেন।
তিনি আমার সঙ্গে ইফতার করবেন না শুনে যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছি মায়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালোবাসা দেখে। সে সময় আমার নিজেকে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ ও হতভাগা সন্তান। যে সন্তান গর্ভধারিণী মা বেঁচে থাকতেও তার হাতের ছোঁয়া, আদর ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত। যে সন্তান স্বাধীন সার্বভৌম দেশ থাকতেও তার বুকে নিরাপদ আশ্রয় ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত।
ভাবনার একপর্যায়ে নিজেরই মনের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম নিল, প্রবাসী না হয়ে আজ যদি আমিও নিজ দেশে মা-বাবার সঙ্গে রমজানের সিয়াম সাধনা করতাম, তাহলে তো সুপারভাইজারের মায়ের মতো আজ আমার মাও ইফতারি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন।
তবে কেন আমি প্রবাসী হলাম? কেন ভালো কর্মসংস্থান বা জীবিকার্জনের তাগিদে আমাকে প্রবাসী হতে হলো? এর জন্য কি শুধু আমিই দায়ী? না, আমি বলব এর জন্য আমি একা দায়ী না, সমাজ ও রাষ্ট্রও এর জন্য দায়ী।
আমার নিজ দেশে কি কর্মসংস্থান নেই? কোনো মিল-কারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান কি নেই। আছে, সবই আছে। আমার জানামতে আমার বর্তমান কর্মস্থান বাহরাইনের চেয়েও আমার নিজ দেশ বাংলাদেশে মিল কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান অনেক বেশি আছে। কিন্তু নেই যোগ্যতা, দক্ষতা ও শ্রমের ন্যায্য মূল্যায়ন।
আর এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলেই আমি মনে করি সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বিদেশিরা আমার দেশে কাজ করতে যাবে। তবে এ জন্য দরকার সরকারসহ সকলের সর্বাত্মক সহযোগিতা।
লিখেছেন মো. মিজানুর রহমান, বাহরাইন থেকে