চলতি দশম জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশন পর্যন্ত কোরাম সংকটের কারণে অপচয় হয়েছে প্রায় ১৫২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট, যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫৫ টাকা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
দশম জাতীয় সংসদের ১৪-১৮তম অধিবেশনের কার্যক্রমের ওপর টিআইবির পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। এছাড়া সংসদকে কার্যকর করতে প্রতিবেদনে ১৪ দফা সুপারিশও করা হয়।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোর্শেদা আক্তার ও নিহার রঞ্জন রায় এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদের ১৪-১৮তম অধিবেশনের গড় বৈঠককাল এবং সদস্যদের গড় উপস্থিতির হার অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদের একই অধিবেশনগুলোর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও কোরাম সংকট প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এছাড়া আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনমত গ্রহণের বিদ্যমান পদ্ধতিগুলোর সীমিত প্রয়োগ, সংসদীয় উন্মুক্ততা চর্চার ঘাটতি, সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিরোধী দলের ব্যর্থতা এবং আইন প্রণয়নে ব্যয়িত মোট সময়ের হার আগের তুলনায় কমে যাওয়াসহ নানা কারণে সংসদের কার্যকরতা প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দশম সংসদের ১৪-১৮তম— এ পাঁচটি অধিবেশনে আগের সংসদের একই অধিবেশনগুলোর তুলনায় সংসদ নেতা ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ সাধারণ সদস্যদের উপস্থিতি ছিল বেশি। এছাড়া অধিবেশনের গড় বৈঠককালও লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। ইতিবাচক এসব পরিবর্তন সত্ত্বেও অধিবেশনগুলোয় মন্ত্রীদের উপস্থিতি কমাসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জও দেখা গেছে। দশম সংসদে উল্লিখিত পাঁচটি অধিবেশনের প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকট ৩০ মিনিট। নবম জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩২ মিনিট।
এতে আরো বলা হয়, কার্যপ্রণালি বিধি লঙ্ঘন করে সরকার ও বিরোধীদলীয় এমপিদের অসংসদীয় আচরণ ও ভাষার ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। আইন প্রণয়নে বিরোধীদলীয় এমপিদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি থাকলেও তাদের মতামত ও প্রস্তাবকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পাশাপাশি আইন প্রণয়নে জনমত গ্রহণের বিদ্যমান পদ্ধতিগুলোর প্রয়োগগত ঘাটতির কারণে জনঅংশগ্রহণের সুযোগও ছিল সীমিত।
এতে আরো বলা হয়, সংসদে নারী এমপিদের উপস্থিতি পুরুষ এমপিদের তুলনায় বেশি ছিল। যদিও অধিকাংশ পর্বের আলোচনায় নারী এমপিদের অংশগ্রহণের হার ছিল তুলনামূলক কম। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বসহ জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পর্বে নারীসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় উত্থাপিত হয়নি। সরকারি ও বিরোধী— উভয় দলের সদস্যদের বক্তব্যে বাজেটে প্রস্তাবিত বিষয়ের ওপর গঠনমূলক সমালোচনা হলেও সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা লক্ষণীয়।
এছাড়া এ সময় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভার সংখ্যা তুলনামূলক বাড়লেও কমিটি সদস্যদের একাংশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব্ব, বিধি অনুযায়ী নিয়মিত সভা না হওয়া, কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্বারোপে ঘাটতি এবং সংসদের কার্যবিবরণী ও কমিটির প্রতিবেদনগুলোর উন্মুক্ততা ও অভিগম্যতার ঘাটতি ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ লক্ষণীয় ছিল। এ সময় ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে ৪৬টির সভা অনুষ্ঠিত হলেও চারটি কমিটির কোনো সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। বিধি অনুযায়ী প্রতি মাসে ন্যূনতম একটি করে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ৪২টি কমিটির। ৫০টি স্থায়ী কমিটির মধ্যে ১৬টির প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১টি কমিটির সদস্যদের সার্বিক গড় উপস্থিতি ৫৬ শতাংশ। পাঁচটি প্রতিবেদনে উপস্থিতি-সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। প্রকাশিত প্রতিবেদনের ৪১ শতাংশ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৪৬ শতাংশ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।