“আমি শতাধিক লোককে হত্যা করেছি, কিন্তু তার জন্য আমার কোন অনুতাপ নেই, কারণ তাদের সবারই মৃত্যুই প্রাপ্য ছিল।” – এ হচ্ছে এমন একজনের কথা – যিনি ছিলেন ইসলামিক স্টেটের একজন ‘ঘাতক’।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন তার কাহিনি – কি ভাবে সিরিয়ার বাশার আসাদ-বিরোধী বিক্ষোভকারী থেকে তিনি একজন সশস্ত্র যোদ্ধায় পরিণত হলেন, নানা সংগঠন ঘুরে একসময় আইএসে যোগ দিলেন, – তার পর আইএস ছেড়ে পালিয়ে তুরস্কে আশ্রয় নিলেন।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে একটি প্রধান রণক্ষেত্র ছিল রাক্কা শহর – বিশেষ করে যখন তা ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর জিহাদিরা দখল করে নিয়ে তাকে তাদের স্বঘোষিত ‘খেলাফতের রাজধানী’ বানায়।
এটি একজন সিরিয়ানের গল্প – যিনি একজন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী হিসেবে বাশার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগ দেন – কিন্তু পরে চারপাশের যুদ্ধ-সহিংসতা-রক্তপাতের পরিবেশের মধ্যে নিজেই পরিণত হন এক ঘাতকে।
খালেদ (আসল নাম নয়) শুধু যে রাক্কার পরিস্থিতির কারণেই একজন হত্যাকারীতে পরিণত হয়েছিলেন তা নয় – তাকে আসলে এ কাজে যোগ দিতে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
খালেদ বলছেন, “আমাদের প্র্যাকটিস টার্গেট ছিল ধরা পড়া সিরিয়ার সরকারী সৈন্যরা। তাদের বসানো হতো কঠিন সব জায়গায়, যেখানে তাদের গুলি করার জন্য স্নাইপার দরকার হতো। কখনো একদল বন্দীকে বাইরে ছেড়ে দেয়া হতো, বলা হতো, তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট একজনকে এমনভাবে গুলি করতে – যাতে অন্য কারো গায়ে গুলি না লাগে।”
তারা আরো প্রশিক্ষণ নেয় কিভাবে মানুষ মারতে হয়। এবং এ কাজে শিকার হিসেবে ব্যবহার করা হতো তাদের হাতে ধরা পড়া বন্দীদের।
ছয় জন লোককে ওই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের বলা হয় আলেপ্পোর একটি বিমানঘাঁটিতে হাজির হতে। সেখানে একজন ফরাসী প্রশিক্ষক তাদের শেখাবে কিভাবে পিস্তল চালাতে হয়, কিভাবে আগ্নেয়াস্ত্রে সাইলেন্সার লাগাতে হয়, আর কিভাবে চালাতে হয় ‘স্নাইপার রাইফেল’ – যা ব্যবহার করে চোরাগোপ্তা বন্দুকধারীরা, লুকোনো একটি জায়গায় বসে থেকে তারা নির্ভুল নিশানায় একটি মাত্র গুলি খরচ করে কাউকে হত্যা করতে পারে।
“বেশির ভাগ সময়ই হত্যাকান্ডগুলো ঘটানো হতো মোটরবাইক থেকে। একজন মোটরবাইক চালাবে, আর তার পেছনে যে বসবে সে গুলি করবে। আপনাকে মোটর বাইকটা লক্ষ্যবস্তুর গাড়ির পাশে নিয়ে যেতে হবে – তার পর তাকে গুলি করতে হবে এবং সে পালাতে পারবে না।”
খালেদ বলছেন, তিনি শিখেছেন কিভাবে কোন লোককে অনুসরণ করতে হয়, কিভাবে অপরিচিত লোকদের দিয়ে টার্গেটকে চিহ্নিত করতে করতে হয়, কি ভাবে একটা গাড়ির বহরকে বিভ্রান্ত করতে হয়।
এটা ছিল একটা রক্তাক্ত, অমানবিক প্রশিক্ষণ।
খালেদ ছিলেন আহরার আল-শামের একটি গ্রুপের কমান্ডার। রাক্কার নিরাপত্তা অফিস ছিল তার দায়িত্বে।
কিন্তু ২০১১ সালে সিরিয়ান বিপ্লবের যখন সূচনা, তখন খালেদ ছিলেন শান্তিপ্রিয় একজন লোক। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “আমি কিছুটা ধার্মিক ছিলাম, তবে খুব গোঁড়া ছিলাম না।”
তিনি প্রথম যেদিন সরকারবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন – সেদিন তার মুক্তি আর সরকার-ভীতি মিলে এক বিচিত্র অনুভুতি হয়েছিল।
প্রথমদিকে ওই সব বিক্ষোভে অস্ত্র নিয়ে যাবার কথা কেউ বলে নি, কারো তেমন সাহসই ছিল না।কিন্তু তবু তাদের নিরাপত্তাবাহিনীর গ্রেফতার দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
একদিন খালেদ নিজেও আটক হলেন। একমাসে কারাগারে থেকে তিনি ছাড়া পেলেন। তবে কারাগারে ঢোকানোর আগে তাকে এত নির্যাতন করা হয় যে তিনি পিঠের ব্যথায় হাঁটতে পারতেন না।
খালেদ বলছিলেন, সবচেয়ে বর্বর অত্যাচার করেছিল বিশেষ একজন নিরাপত্তা রক্ষী।
সে খালেদকে বাশার আসাদের একটা ছবির সামনে হাঁটু মুড়িয়ে বসাতো, বলতো “তোমার ঈশ্বর মারা যাবে, কিন্তু বাশার আসাদ মারা যাবে না। সে টিকে থাকবে।”
খালেদকে সিলিং থেকে বেঁধে ঝোলানো হতো, কাপড় খুলে তাকে পেটানো হতো। সেই রক্ষীটা বলতো “আমি তোমাকে ঘৃণা করি, আমি চাই তুমি আমার হাতে মরো।”
খালেদ বলেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে যদি আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে আমি যেভাবেই হোক ওকে হত্যা করবো।”
ছাড়া পাবার পর বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেবার পর খালেদ সত্যি সত্যি খুঁজে বের করেছিলেন ওই নিরাপত্তা রক্ষীকে।
“আমি তাকে ধরে নিয়ে গেলাম একটা বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। আমি তার হাত ও জিভ কেটে ফেলেছিলাম, কিন্তু তাতেও আমার তৃপ্তি হয় নি। সে যখন আমাকে অনুনয় করছিল তাকে মেরে ফেলার জন্য তখনই আমি তাকে হত্যা করি। আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছিলাম – তাই আমার কোন ভয় করে নি। তাকে অত অত্যাচার করার পরও আমি কোন দু:খ বা অনুতাপ বোধ করি নি।।”
কিছুদিন পর খালেদ বিপ্লবের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন। শুধু তার নিজের টিকে থাকার জন্যই তিনি যুদ্ধ করছিলেন।
যুদ্ধকৌশল নিয়ে বিবাদ, প্রতারণা, ক্ষমতার লড়াইয়ে নানা পরিবর্তন – এসব নানা কারণে বিদ্রোহীরা অনেকেই দল পরিবর্তন করতে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটেই খালেদ আহরার আল-শাম ত্যাগ করেন – যারা তাকে একজন ঘাতক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এর পর তিনি যোগ দেন আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট আল-নুসরা ফ্রন্টে। সে সময় ইসলামিক স্টেট ছিল ছোট সংগঠন, খালেদ এবং তার সাথীদের হাসি-ঠাট্টার পাত্র। কিন্তু সেই আইএসই ২০১৪ সালে রাক্কা দখল করে নিয়ে তাকে তাদের খেলাফতের রাজধানী ঘোষণা করে। সেখানে তারা কয়েম করে এক ত্রাসের রাজত্ব।
শিরশ্ছেদ, ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা, নির্যাতন, শিশুদের সামনে মেয়েদের মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে হত্যা, ধর্ষণ – রাক্কায় সবই করেছে আইএস, বলছিলেন খালেদ ।
আইএস অন্য দলগুলোর উর্ধতন বিদ্রোহী নেতাদের টাকা এবং বড় পদ দিয়ে ‘কিনে’ নেয়। খালেদকে প্রস্তাব দেয়া হয় তাদের একজন নিরাপত্তা প্রধান হবার।
খালেদ বলেন, তিনি বুঝতে পারছিলেন যে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হলো মৃত্যু পরোয়ানায় সই করা। কাজেই তিনি এক ফন্দি আঁটলেন।
“আমি রাজি হলাম, এবং আল-নুসরার নেতা আবু আল-আব্বাসের অনুমতি নিয়ে একজন ডাবল এজেন্ট হয়ে গেলাম। আমি তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখতাম, কিন্তু গোপনে তাদের সদস্যদের অপহরণ করে হত্যা করতাম।”
“আবু আল-আব্বাস যা চাইতো তা আমি আইএস-এর কাছে ‘ফাঁস’ করে দিতাম। এর মধ্যে কিছু সঠিক তথ্যও থাকতো – যাতে আইএস আমাকে বিশ্বাস করে। কিন্তু পাশাপাশি আমি তাদের গোপন তথ্যগুলো জেনে নিতাম।”
খালেদ পরিণত হলেন ইসলামিক স্টেটের একজন ঘাতকে।
খালেদ বলছেন, আইএসের হয়ে তিনি অন্তত ১৬ জনকে হত্যা করেছেন, তাদের বাড়িতে ঢুকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে।
তার একজন শিকার ছিল একজন ইসলামিক আলেম।
“আমি পিস্তল উঁচিয়ে তার বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে তার স্ত্রী চিৎকার করতে লাগলো। সেই আলেম বললো, তুমি কি চাও, টাকা? নিয়ে যাও।যদি আমার স্ত্রীকে চাও, তুমি আমার সামনেই তার সাথে শুতে পারো, কিন্তু আমাকে মেরো না। কিন্তু তার কথা শুনে আমি তাকে হত্যা করতে আরো উৎসাহিত হলাম।”
আইএসের আমিররা নতুনত্ব ভালোবাসতো। কিছুদিন পর পরই তাদের নিজেদেরই কেনা লোকদের তারা হত্যা করে তাদের জায়গায় নতুন লোক বসাতো। কখনো বলতো, মার্কিন-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের হামলায় সে মারা গেছে। কখনো কখনো সেটা বলার পরোয়াও করতো না।
মাসখানেক পরই খালেদ বুঝলেন. আইএস শিগগিরই তাকেও মেরে ফেলবে।
ফলে ঘাতক নিজেই প্রাণের ভয়ে পালালেন, একটা গাড়ি নিয়ে দেইর আল-জুর চলে গেলেন, তার পর সেখান থেকে এলেন তুরস্কে।
“আমি বিভিন্ন যুদ্ধে ১০০-র বেশি লোককে হত্যা করেছি। আমি এ নিয়ে অনুতাপ বোধ করি না। কারণ আল্লাহ জানেন আমি কখনো কোন বেসামরিক লোক বা নিরপরাধ লোককে হত্যা করি নি।”
খালেদের কথা: “আমি যা করেছি তা অপরাধ নয়, আপনি যথন দেখবেন কেউ আপনার বাপ-ভাই বা আক্মীয়স্বজনকে হত্যা বা নির্যাতন করছে তখন আপনি চুপ করে থাকতে পারবেন না। আমি যা করেছি তা আত্মরক্ষার্থে।”
“আমি যখন আয়নায় নিজেকে দেখি আমি নিজেকে একজন রাজপুত্র মনে করি। রাতে আমার ভালো ঘুম হয়। কারণ ওরা আমাকে যাদের হত্যা করতে বলেছিল -তারা সবারই মৃত্যুই প্রাপ্য ছিল।”
আমি সিরিয়া ছেড়ে আসার পর আবার এজন বেসামরিক লোক হয়ে গেছি। এখন যখন আমাকে কেউ কোন রূঢ় কথা বলে – আমি শুধু তাদের বলি , “আপনি যা মনে করেন।” বিবিসি থেকে