নীতু আক্তারের বয়স মাত্র এগারো। তবে তাকে দেখলে মনে হবে ৬০ বছরের বৃদ্ধা। মুখ, শরীরের চামড়া কুঁচকানো, মাথাতেও কোন চুল নেই। বিরল প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত নীতু ক্রমেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের হিসাবে, তার আয়ু আছে আর মাত্র কয়েক বছর।
হবিগঞ্জে ২০০৭ সালে নীতুর জন্ম হয়। ছয় ভাইবোনের পরিবারে সে চতুর্থ।
তার বাবা কামরুল ইসলাম বিবিসিকে বলছেন, তিন মাস বয়স থেকেই তার শরীরের চামড়া শক্ত হয়ে যেতে শুরু করে। তখন স্থানীয় চিকিৎসকদের দেখানো হয়। তারা নানা ওষুধও দিয়েছেন, কিন্তু রোগটি ঠিকভাবে কেউ ধরতে পারেন নি। পাঁচ বছর বয়সের সময় ঢাকার চিকিৎসকরা জানান, নীতু বিরল প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। এ ধরণের রোগীদের বেঁচে থাকার গড় বয়স ১৩ বছর।
হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোঃ আবু সুফিয়ান বিবিসিকে বলেন, সারা বিশ্বে প্রতি ৪০ লাখের মধ্যে একজন এ ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এখনো এর পুরো চিকিৎসা বের হয়নি। এ ধরণের রোগে আক্রান্তদের বেঁচে থাকার গড় বয়স ১৩ বছর।
তার বাবা কামরুল ইসলাম জানান, নীতুর কথাবার্তা, চলাফেরা খুব স্বাভাবিক। সে পড়াশোনাতেও ভালো। তবে খাবারদাবার কম খেতে চায়।
হবিগঞ্জের একজন সমাজকর্মী চৌধুরী জান্নাত রাখী জানান, এই বয়সের অন্য শিশুদের তুলনায় নীতুর বুদ্ধিও অনেক বেশি। স্থানীয় অনেক অনুষ্ঠানে সে অংশ নিয়েছে। আদর, ভালোবাসা বা অবহেলার বিষয়গুলো সে সহজে ধরতে পারে। নীতুর রোগের চিকিৎসা নেই জানার পরেও তারা বাবা-মা জায়গাজমি বিক্রি করে তাকে সিলেট, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও সে কিছুদিন ভর্তি ছিল। মাঝে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেও, এখন খানিকটা ভালো।
ডা. আবু সুফিয়ান বলছেন, প্রজেরিয়া জিনেটিক সমস্যা হলেও, এটি ছোঁয়াচে নয়। বাবা-মায়ের কাছ থেকে সে পেয়েছে বা অন্য স্বজনদের হতে পারে এমনও নয়। স্থানীয় একটি স্কুলে ক্লাস টুতে পড়াশোনা করছে নীতু।
প্রজেরিয়া রোগটি আসলে কী?
প্রজেরিয়া এক ধরণের জিনেটিক ডিজঅর্ডার, যা বেশ বিরল। চিকিৎসকদের হিসাবে, প্রতি ৪০ লাখে একজনের মধ্যে এ ধরণের রোগ দেখা যায়। তবে এ পর্যন্ত বিশ্বে বড়জোর ১০০ প্রজেরিয়া আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা গেছে। প্রজেরিয়া শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ প্রজেরাস থেকে, যার অর্থ অপ্রাপ্তবয়স্ক বৃদ্ধ। ১৮৮৬ সালে ড. জোনাথন হাচিনসন আর ১৮৯৭ সালে ড. হেস্টিংস গিলফোর্ড রোগটি সম্পর্কে আলোকপাত করেন বলে এর আরেক নাম হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রজেরিয়া সিনড্রোম।
কোষের এক ধরণের বিক্রিয়ার কারণে দেহের কোষ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বয়োবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি দ্রুত হয়ে যায়। তবে জিনেটিক রোগ হলেও, এটি বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোন রোগ নয়। এ রোগে আক্রান্তদের গড় বয়স ১৩ বছর। এরপর হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
সাধারণত শিশু জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই রোগটি সনাক্ত হয়ে যায়। রোগে আক্রান্তদের মাথা শরীরের তুলনায় বড় হয়, চামড়ায় ভাজ পড়ে এবং মাথার চুল পড়ে যায়।
বাংলাদেশে প্রজেরিয়া
চিকিৎসকরা বলছেন, বিরল হলেও বাংলাদেশে এ ধরণের রোগে আক্রান্ত বেশ কয়েকজন রোগী পাওয়া গেছে। মাগুরার পাঁচ বছরের শিশু বায়েজিদ শিকদার গত বছর ডিসেম্বরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এছাড়া সিলেটের জকিগঞ্জে আবদুর নূর ও জয়পুরহাটে তুহিন ইসলাম রাজু এ রোগে আক্রান্ত বলে বলে জানা গেছে।
প্রজেরিয়া রোগটি নিয়ে ব্রাড পিট অভিনীত ‘দি কিউরিয়াস কেস অ বেনজামিন বাটন’ আর ভারতে অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘পা’ চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।