কিশোরগঞ্জ সদরের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজের পাশে ছোট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন শাহীনুর বেগম (৪০)। স্বামী গত হয়েছেন কয়েক বছর হয়েছে। একমাত্র কিশোরী (১৬) মেয়েকে নিয়ে তিনি ওই বাসায় থাকেন।
অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালান। অভাব-অনটনের কারণে মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ। মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই মায়ের।
এমতাবস্থায় গত কয়েক মাস আগে শাহীনুরের সঙ্গে পরিচয় হয় পার্শ্ববর্তী এলাকার আকলিমা নামে এক দালালের সঙ্গে। আকলিমা একসময় সৌদিতে ছিলেন। দেশে ফেরার পর মহিলাদের বিদেশ পাঠানোর দালালি করেন। আকলিমা শাহীনুরকে বিদেশ যাওয়ার প্রলোভন দেখায়।
মাসে বেতন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। উপরন্তু কোনো টাকা-পয়সা লাগবে না। পাসপোর্ট করার জন্য শুধু ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। আকলিমার লোভনীয় এমন প্রস্তাবে রাজি হয় শাহীনুর। ধার করে ১০ হাজার টাকা তুলে দেয় শাহীনুরের হাতে।
২ মাস আগে আকলিমার সঙ্গে ঢাকায় এসে পাসপোর্ট অফিসে ছবি তুলেছিলেন শাহীনুর। তবে পাসপোর্ট হাতে পাননি। এ অবস্থায় পাসপোর্ট রেডি হয়েছে এবং কয়েক দিনের মধ্যে শাহীনুরকে বিদেশ পাঠানো হবে জানায় আকলিমা। আকলিমা আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছিল।
কয়েক দিন পূর্বে শাহীনুর ও তার কিশোরী মেয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে অচেনা ঢাকায় এসে কমলাপুর রেলস্টেশনে নামলে আকলিমা তাদের কেরানীগঞ্জে অপর দালাল মনিরের বাসায় নিয়ে তোলে।
সেখানে দুদিন অবস্থানের পর মনির আকলিমাকে জানায়, তার বিদেশ যেতে কিছুটা দেরি হবে। আকলিমা যেন কিশোরগঞ্জ চলে যায়। এক সপ্তাহ পর তাকে ঢাকায় ফিরতে বলা হয়।
এ সময় তারা আকলিমাকে ভুল বুঝিয়ে ওই বাসায় মেয়েকে রেখে যেতে বলে। সরল বিশ্বাসে আকলিমা কিশোরগঞ্জে চলে যায়। এক সপ্তাহ পর কেরানীগঞ্জে মনিরের বাসায় এলে তিনি জানতে পারেন দালাল মনিরের ছোট ছেলের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। যদিও তাদের বিয়ে হয়নি। তারা একসঙ্গে বসবাসও করছে।
এ নিয়ে শাহীনুর প্রতিবাদ করলে তাকেও ওই বাসায় আটকে রাখা হয় এবং মেয়েকে প্রচণ্ড মারধর করে ভয় দেখানো হয়।
গত রোববার সেখান থেকে পালিয়ে শাহীনুর কিশোরগঞ্জে চলে আসেন। পরে লোকজনের পরামর্শে ঢাকার সিআইডি অফিস হয়ে কেরানীগঞ্জ র্যাব-১০ কার্যালয়ে অভিযোগ করলে মঙ্গলবার রাতে কদমতলী মডেল টাউনের ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে শাহীনুরের মেয়েকে উদ্ধার করে র্যাব।
আটক করা হয় মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য মনির হোসেন ও তার দুই ছেলে শরীফ হোসেন খোকন, আরিফ হোসেনকে।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি শাকের মোহাম্মদ যোবায়ের জানান, র্যাব ভিকটিম ও আটককৃতদের তাদের হেফাজতে দেয়ার পর বুধবার শাহীনুর আক্তার বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলা হওয়ার পর মনিরের ছোট ছেলে ও কথিত জামাই বাবুকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে মানবপাচার, আটকে রাখা, প্রতারণা, মারধর ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
ওসি আরও জানান, গ্রেফতারকৃতরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দালালদের মাধ্যমে সহজ-সরল ও গরিব নারীদের টার্গেট করে। বিনা পয়সায় বিদেশ যাওয়ার কথা বলে তাদের সৌদি আরব, ওমান, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে পাচার করা হয়। সেখানে তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন ও যৌন অত্যাচার। শেষে নিঃস্ব হয়ে তারা দেশে ফেরেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাদিকুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন শাহীনুরকে বিদেশে পাচারের উদ্দেশে আকলিমা তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। ঢাকায় আসার পর মায়ের সঙ্গে তার সুন্দরী কিশোরী মেয়েকে পাচারের পরিকল্পনা করে তারা।
এ জন্য কৌশলে ফ্লাইট দেরির কথা বলে শাহীনুরকে কিশোরগঞ্জ পাঠিয়ে দেয়। এদিকে ওই মেয়েকে দালাল মনির তার ছোট ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছে বলে প্রচার চালায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, শাহীনুরের মেয়েকে বউ হিসেবে তাদের কাছে রেখে দেবে। আর শাহীনুরকে বিদেশে পাচার করে দেবে।
শাহীনুরকে পাঁচারের পর তার মেয়েকেও পাঁচার করে দেয়া হতো। তবে এর আগেই তারা ধরা পড়েছে। তবে ভুয়া বিয়ের নামে শাহীনুরের মেয়েটিকে দুই সপ্তাহ ধর্ষণ করেছে বাবু। এদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
পাশাপাশি ধর্ষণের শিকার ওই মেয়েকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতার হওয়া মনির হোসেন একসময় পাসপোর্ট অফিসে দালালি করতেন। সেখান থেকেই তিনি মানবপাচারের সঙ্গে জড়িয়ে যান। ধীরে ধীরে তিনি এ কাজে তার ৩ ছেলেকেও যুক্ত করেন।
মনির হোসেন দরিদ্র ঘরের সুন্দরী মেয়েদের ভুয়া বিয়ের মাধ্যমে তার ছেলের বউ করে ঘরে রাখেন। এরপর সময়-সুযোগমতো তাদের বিদেশ পাচার করে দিতেন।
এ রকম একাধিক মানবপাচারকারী চক্র কেরানীগঞ্জে সক্রিয় রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান হতে দরিদ্র নারীদের ফুসলিয়ে ঢাকায় এনে বিদেশ পাচার করে দেন।